১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চট্টগ্রাম কারাগারে ‘ইমারজেন্সি কলে’ সাক্ষাৎ করানোর নামে দেদার ‘ঘুষবাণিজ্য’

সরেজমিন
-


কারাবন্দীর সাথে ‘ইমারজেন্সি কলে’ সাক্ষাৎ করানোর নামে স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কারাগারে গড়ে ওঠা দুষ্ট সিন্ডিকেট। শুধু ইমারজেন্সি কলের নামেই নয়, কারা হাসপাতালে ভালোভাবে রাখার নামেও কৌশলে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এই কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে সিন্ডিকেট সদস্য, বন্দীর স্বজন ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
বর্তমানে এই কারাগারে সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) পদে দায়িত্বে আছেন মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন। অন্য দিকে জেলার পদে আছেন মো: মাসুদুর রহমান। খোঁজ নিয়ে ও কারা অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা পাঁচ হাজার ৪৪৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ পাঁচ হাজার ১৭৩ এবং মহিলা ২৭০ জন।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে বলা হয়, বন্দী সংখ্যার দিক থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কারাগার। কোতোয়ালি থানাধীন ঐতিহ্যবাহী লালদীঘির পূর্ব পাশে ১৮৮৫ সালে চট্টগ্রাম জেলা কারাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এটি কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত হয়। ১৬.৮৭ একর জমির ওপর কারাগার নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে পেরিমিটার দেয়ালের ভেতর ১১.৫৫ একর এবং বাইরে রয়েছে ৫.৩২ একর।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সব ধরনের বন্দী রাখা হয় বিধায় সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয়। এর মধ্য বাঁশ ও বেতের হরেক রকম সামগ্রী, তাঁতের কাপড়, পোশাক, কাঠের আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরি করা হয়। বেকারিজাত খাদ্যপণ্য বন্দীরা পিসির মাধ্যমে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাইরের দোকান থেকে কিনে থাকেন। বন্দীরা নিজেদের খাবার নিজেরাই তৈরি করে বিধায় রান্নার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মুক্তির পর অনেক বন্দী পেশাদার বাবুর্চি হিসেবে রেস্টুরেন্টে কাজ করার সুযোগ পায়। কারাগারে কারা হাসপাতাল রয়েছে। তবে প্রয়োজনের থেকে জনবল অনেক কম। সহকারী সার্জন না থাকায় এবং এক-দু’জন ফার্মাসিস্ট বা ডিপ্লোমা নার্স দিয়েই হাসপাতাল পরিচালিত হয়ে থাকে। সন্ধ্যায় তালাবদ্ধের পর অসুস্থ বন্দীদের সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরাই দেখাশোনা করে থাকে বলে কারা অধিদফতরের নিজস্ব ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্যে উল্লেখ রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, বন্দীর স্বজনরা ঝুম বৃষ্টির কারণে কারাগারসংলগ্ন মোবাইলের দোকানের সামনে আবার কেউ আশপাশের দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন। কারাগারের সাক্ষাৎকক্ষে ফ্রি স্লিপ কেটে দেখা করতে গিয়েও অনেকে ফিরে আসেন। কারণ বৃষ্টির জন্য বন্দীদের খবর দেয়া হলেও তারা আসেন না। এমন কয়েকজনকে এ সময় ফিরে যেতে দেখা যায়।
কারাগারের গেটে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে দোকান করছেন এমন একজনের সাথে পরিচয় গোপন রেখে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, বর্তমানে এই কারাগারে চার হাজারের মতো বন্দী আছে। রাজনৈতিক মামলা কমে যাওয়ায় বন্দীর সংখ্যা এখন কম। বন্দীর সাথে স্বজনদের মুখোমুখি সাক্ষাৎ করার সুযোগ আছে কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুখোমুখি সাক্ষাতের সুযোগ এখন আর নেই। তবে দোতলার জালি দিয়ে ‘ইমারজেন্সি কলে’ যে কেউ টাকা খরচ করে অনায়াসে সাক্ষাৎ করতে পারছেন।

‘ইমারজেন্সি কল’ আনার কী?Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে ওই দোকানি বলেন, একজন বন্দীর সাথে তার স্বজন সাক্ষাৎ করার সাত দিনের আগে যদি আবার সাক্ষাৎ করতে আসে, তখন তাকে ইমারজেন্সি কলে দেখা করানোর ব্যবস্থা করানো হয়। এর জন্য হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা দিতে হয়। তার সাথে কথা বলার সময় কালো মোটা চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি এসে ইমারজেন্সি কলে দেখা-সাক্ষাৎ কিভাবে করানো হয় তার গল্প শুরু করেন। ওই ব্যক্তি বহিরাগত জানিয়ে দোকানি বলেন, তার সাথে কারাগারের লোকজনের ভালো লিংক আছে। শুধু উনি না, অনেকেই টুকটাক দেখা সাক্ষাৎ করানোর কাজ করে থাকেন বলে জানান তিনি।
এ সময় কথার ফাঁকে চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তি বলতে থাকেন, ‘আমি একজন আসামিকে ইমারজেন্সিীকলে সাক্ষাৎ করানোর জন্য এক হাজার ৩০০ টাকা চুক্তি করি। আমার কারা কর্মকর্তাদের সাথে লিংক ভালো থাকায় দ্রুত তাদেরকে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেই। ওই লোকটি খুশি হয়ে আমাকে এক হাজার ৩০০ টাকার বদলে তিন হাজার টাকা দিয়ে যান।’ এ সময় তারা দু’জনই বলেন, এমনিতে এখন কোনো বন্দীর সাথে কথা বলতে একটি টাকাও লাগে না। শুধু আসামির নাম, সেলের নাম, কোন থানা এবং মামলা নম্বর উল্লেখ করে স্লিপ জমা দিলেই সাক্ষাৎ কক্ষে আসামি চলে আসবে। তবে এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো ২ ঘণ্টা লেগে যায়। যেমন আজকে বৃষ্টির কারণে স্লিপ কাটা আসামিকে ডাকার পরও কেউ কেউ আসেনি। কারণ কারাগারের যেখানে সেল সেখান থেকে আসতে মাঝখানে মাঠ পড়ে। মাইকে কল দেয়ার পরও সেটি পার হয়ে অনেকে আসতে চায় না।

কথা বলার কিছুক্ষণ পর একজন নারী কোলে সন্তান নিয়ে কারাগার এলাকা থেকে বেরিয়ে সিএনজিতে উঠছিলেন। এ সময় তার কাছে কারো সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি স্লিপ কেটে আমার স্বামীর সাথে দেখা করে এসেছি। সাক্ষাৎ করতে কোনো টাকা লাগেনি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার স্বামী রাজনৈতিক মামলার আসামি। কোর্টে আত্মসমর্পণ করে এখন ভেতরে আছেন। ভেতরে কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারাগারে কেমন থাকবে তা তো সবাই জানে। তবে এখন টাকা হলে কারাগারে সব কিছু পাওয়া যায়। সরকারি খাবারের মান কেমনÑ এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে ওই নারী বলেন, এটার মান খারাপ দেখেই তো বেশির ভাগ বন্দী পিসিতে টাকা জমা দিয়ে খাবার কিনে খান। আপনার স্বামী কোন থানার মামলার আসামি জানতে চাইলে তিনি সাংগু ও পদ্না নামক সেলে আছেন বলেই সিএনজিতে উঠে পড়েন।
এ সময় তার সাথে আরো দু’জন সদস্য ছিলেন।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যার আগে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেনের কাছে টাকার বিনিময়ে ‘ইমারজেন্সি কলে’ বন্দীদের সাক্ষাৎ করানো এবং বন্দীদের থাকা খাওয়া এবং চিকিৎসার বিষয়ে বক্তব্য জানতে তিনবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পরে কারা অধিদফতরের কারা উপ-মহাপরিদর্শক (সদর দফতর) মনির আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনিও টেলিফোন রিসিভ করেননি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের দু’জনের কেউ কল ব্যাকও করেননি।

 


আরো সংবাদ



premium cement