আরো সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা উধাও
- হামিদ সরকার
- ১৫ জুন ২০২৪, ০০:০৫
- বাংলাদেশে পুঁজিবাজার নামের পিলারটি খুবই দুর্বল : ড. সালেহউদ্দিন
- সরকারি ১২ শতাংশ অফারে বড় বিনিয়োগকারীরা চলে যাচ্ছে : আবু আহমেদ
- সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে এই মার্কেট মুখ থুবড়ে পড়বে : সাধারণ বিনিয়োগকারী
তালিকাভুক্ত ও নন-তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করের হারের পার্থক্য কমানোর জন্য বাজেটের প্রস্তাবনাগুলো বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। একটি অনিশ্চিত বাজারে প্রস্তাবিত বাজেটে মূলধন লাভে কর আরোপের প্রস্তাবের কারণে টাকা তুলে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এমনিতেই বাজারের মন্দাবস্থা দেড় মাস ধরে, তার ওপর পুঁজিবাজারের জন্য এই ধরনের খড়গে বিনিয়োগকারী টাকা তুলে নিয়েছেন ঈদের আগেই। ফলে বাজেট প্রস্তাবের পরের সপ্তাহেই ২১ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা বাজারমূলধন থেকে সরে গেছে।
বাজেট আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের ‘স্টক মার্কেট’ নামের পিলারটিও খুব দুর্বল। পার্শ্ববর্তী দেশের পুঁজিবাজারের সেনসেক্স বেড়ে অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। আর আমাদের দেশের পুঁজিবাজার এখনো দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। একজন বিনিয়োগকারী বলছেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে এই মার্কেট কখনোই টেকসই হবে না, বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদের মতে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেহেতু বিদেশে তাদের লভ্যাংশগুলো নিয়ে যেতে পারে না, তাই লভ্যাংশ দেয়া কমিয়ে দিয়েছে। যেসব কোম্পানির ওপর ভরসা করে অনেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে গেছেন, এসব বহুজাতিক কোম্পানির মূল শেয়ারহোল্ডার বিদেশী।
ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই খাতের অর্ধেক ব্যাংক হলো দেউলিয়া। যেটা ১০ বছর আগে ছিল না। বীমা কোম্পানির ৭০ শতাংশ হলো দেউলিয়া ও প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত। আর মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে বিনিয়োগকারীরা বিশ^াস করে না। দেশের অর্থনীতির অবস্থাও ভালো না। সরকার যেখানে ১২ শতাংশ সুদ অফার করছে, সেখানে পুঁজিবাজারে ১২ শতাংশ পাওয়া তো কঠিন। যারা বড় বড় বিনিয়োগকারী তারা সরকারের ওই অফারে চলে গেছে। যার কারণে তারল্য সঙ্কটে দেশের পুঁজিবাজার। ১৯৯০ ও ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে যে ক’টা কোম্পানি এসেছিল তারা কর সুবিধা নিতে। সরকার এদের এনেছে সেটা না। সরকারের উচিত ছিল বাজারের জন্য ভালো কোম্পানি আনার ক্ষেত্রে পারসু করা। অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে যারা বোম্বেতে তালিকাভুক্ত, কিন্তু বাংলাদেশে নেই।
ইবিএল সিকিউরিটিজ সাপ্তাহিক বাজার পর্যালোচনায় বলছে, তালিকাভুক্ত ও নন-তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করের হারের পার্থক্য কমানোর জন্য বাজেটের প্রস্তাবনাগুলো বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। একটি অনিশ্চিত বাজারের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তাদের পুঁজিবাজারের এক্সপোজারকে আরো কমাতে প্ররোচিত করে। সপ্তাহের প্রথম তিন সেশনে বিক্রেতাদের হাতে বাজারের গতির লাগাম। বেঞ্চমার্ক সূচককে ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ স্তরে ফেলে দিয়ে বাজারটি একটি নেতিবাচক লেনদেনে সপ্তাহ শুরু করেছিল। দর কষাকষিকারীরা সপ্তাহের শেষ দুই দিনে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। কারণ তারা প্রস্তাবিত মূলধন লাভ করের সম্ভাব্য প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রচলিত গুজবের কারণে ইতিবাচক প্রত্যাশার সাথে কম দামের স্ক্রিপগুলিতে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিস্তৃত সূচক ডিএসইএক্স ১১৯.৫ পয়েন্ট বা ২.৩ শতাংশ হারিয়ে ৫ হাজার ১১৮ পয়েন্টে স্থির হয়েছে। গড় লেনদেন ১৬.৬ শতাংশ কমে ৩৭৬ কোটি ৫০ হাজার টাকা হওয়ায় বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণও কমেছে।
লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিএসইর সার্বিক লেনদেনের অবস্থা এক বচর আগের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি। ডিএসইর প্রধান সূচক আরো ১১৯ পয়েন্ট এবং সিএসইর প্রধান সূচক প্রায় ৪০০ পয়েন্ট হারিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা বেশির ভাগই ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে ২৩.৩ শতাংশ, খাদ্য খাতে ১৪.৯ শতাংশ এবং বস্ত্র খাতে ১১.০ শতাংশ সক্রিয় ছিলেন। পাট খাত ১০.৭ শতাংশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সাথে সেক্টরগুলো লাল রঙে শেষ হয়েছে। ডিএসইর সূচকের পতন পরিস্থিতি এক বছর আগের চেয়েও বেশি খারাপ। ডিএসইএক্স ১১৯.৫১ পয়েন্ট, ডিএসই-৩০ সূচক ৩৬.০৯ পয়েন্ট, শরিয়াহ ২৮.৭ পয়েন্ট এবং এসএমই সূচক ৪৪.০৮ পয়েন্ট ঝরে গেছে এক সপ্তাহের লেনদেনে। ব্লক মার্কেটে ২৭৩ কোটি ৩৩ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড বেচাকেনা হয়েছে। আর এসএমইতে ৪৫ কোটি ৭৫ লাখ ৭০ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে।
ডিএসইতে প্রতিদিন গড় লেনদেন কমেছে ১৬.৬৪ শতাংশ, শেয়ার লেনদেন কমেছে ২৯.৯৬ শতাংশ। আর সপ্তাহে মোট ৩৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার লেনদেন কমেছে আগের সপ্তাহের তুলনায়। অন্য দিকে শেয়ার বেচাকেনা কমেছে আগের সপ্তাহের তুলনায় সদ্য বিদায়ী সপ্তাহে ২২ কোটি ৩ লাখ ৩০ হাজারটি। পুরো সপ্তাহে লেনদেনে অংশ নেয়া কোম্পানিরগুলোর মধ্যে দর পতনের শিকার ৩২৩টি। আর দর বৃদ্ধিতে ছিল ৫৪টি এবং দর অপরিবর্তিত ছিল ১৭টির। তবে ১৮টি কোম্পানির শেয়ার কোনো ধরনের লেনদেনে অংশ নেয়নি।
এ দিকে গেলো সপ্তাহে চট্টগ্রাম স্টকে ৬ কোটি ৫১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫০টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড বেচাকেনা হয়েছে মোট ৩৬৭ কোটি ৫২ লাখ ১৭ হাজার ১৭৬ টাকায়। সপ্তাহজুড়ে লেনদেনে অংশ নেয়া ৩১৩টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৪৬টির। দর হারিয়ে লোকসানে ছিল ২৪৬টি কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগকারীরা। আর দর অপরিবর্তিত ছিল মাত্র ২১টি কোম্পানির। বাজারমূলধনে গেলো সপ্তাহে এ শ্র্রেণীর শেয়ারের অংশ কমেছে। এ শ্র্রেণীর ৬৭.৭৮ শতাংশ, বি শ্র্রেণীর ৩০.৭৪ শতাংশ, এন শ্র্রেণীর ১.৩৬ শতাংশ এবং জেড শ্র্রেণীর ০.৫২ শতাংশ অংশীদারিত্ব ছিল।
পুরো সপ্তাহে সূচকের ধারাবাহিত পতনের ফলে সিএএসপিআই সূচক ৩৯৯.৬০ পয়েন্ট কমেছে। সিএসসিএক্স সূচক ১৭৫.৯৩ পয়েন্ট এবং সিএসই-৩০ সূচক ২৪১.২১ পয়েন্ট হারিয়েছে। অব্যাহত দর ও সূচক হারিয়ে বাজারমূলধন কমেছে সিএসইতে আট হাজার ৭২৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এই স্টকের বাজারমূলধন কমে এখন ছয় লাখ ৬৬ হাজার ৪৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
একজন তরুণ বিনিয়োগকারী ও বাজার বিশ্লেষক বলছেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য যেন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে শেয়ারবাজার। নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির যেন উর্বর ভূমি এই শেয়ারবাজার। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটি কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া যায় না। এখনই রাষ্ট্রকে এগিয়ে আশা উচিত আর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা