১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নিয়ে শঙ্কা

ভাঙনের কবলে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নে চরবালীয়াতলী গ্রামের বেরিবাঁধ : নয়া দিগন্ত -


সামনেই ঘূর্ণিঝড় মৌসুম। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপকূলের শত শত মানুষ। উপজেলার আয়তন ৪৯২.১০ বর্গকিলোমিটার। এখানে ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভা, ২৪৪টি গ্রাম রয়েছে। উপজেলা ২২টি স্পটে ৯.১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় যদি উপকূলে আঘাত নাও হানে, তবুও এর প্রভাবে নদ নদীতে পানির চাপ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ পর্যন্ত যতগুলো দুর্যোগ এসেছে, এর বেশির ভাগই মে মাসে। এ জন্য মে মাস এলে আতঙ্কিত থাকে উপকূলের মানুষ।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, গত এক দশকে মে মাসে আটটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের রেমাল ২৪ মে, ২০১৯ সালের ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরা ও ২০১৩ সালের ১৬ মে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০২৪ সালের ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় সিডর এখনো দগদগে। এতকাল যত দুর্যোগ এসেছে, অধিকাংশই মে মাসে। এ জন্য মে মাস এলেই আতঙ্কে থাকেন উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড় না হলেও এর প্রভাবে নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। এসব এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি বাড়লে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪৭/৪ পোল্ডারের মিঠাগঞ্জ বেড়িবাঁধ ইতোমধ্যে বাঁধের রিভার সাইডের মূল বাঁধ স্লোবসহ বাঁধ রায় দেয়া জিওব্যাগ ধসে আন্ধারমানিক নদীতে পড়ে গেছে। ভাঙন শুরু হয়েছে বাঁধের কান্ট্রি সাইডেও। বর্তমানে যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তাতে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় ফাঁটল। এ কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে পাঁচটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। ৪৬ পোল্ডারের নীলগঞ্জ ইউনিয়নে গৈয়াতলা গ্রামের ভাঙা বাঁধ সংলগ্ন ছয়টি গ্রামের মানুষ রয়েছে আতঙ্কে। বাঁধসহ স্লুইস ভেঙে পড়ার পর এবার বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়ায় চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে এলাকার মানুষ। সোনাতলা নদীর ঢেউয়ের তোড়ে গৈয়াতলা বেড়িবাঁধের রিভার সাইডের বাঁধ সোনাতলা নদীতে ভেঙে পড়েছে। বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ফাটল। সম্পদ হারাণোর আর্তনাদে ক্রমে ভারী হচ্ছে ৪৭ পোল্ডারের মহিপুর ইউনিয়নে সিডরের পর থেকে নিজামপুর পাঁচ গ্রামের মানুষ দশ বছর ধরে জমিতে কোনো চাষ করতে পারেনি। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড জনগণের দুর্ভোগ লাগবে এখানে রিং বেড়িবাঁধ করে দেয়। এখন আবার নতুন করে আতঙ্কে রয়েছে মানুষ। হুমকিতে পড়বে উপজেলা নিজামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাকা ব্লক ফেলে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই ভাঙছে নতুন করে একেকটি পরিবারের স্বপ্ন। সাগর ও নদীর প্রতিটি জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বসতঘর, আবাদি জমি ও মাথাগোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু। নিঃস্ব হতে হতে এই গ্রামের মানুষের শেষ সম্বল এখন শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সময় মতো মেরামতের উদ্যোগ নিলে কম খরচ ও কম সময়ের মধ্যে মানসম্মত কাজ সম্ভব। তবে বর্ষার আগ মুহূর্তে যখন নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাঁধ কানায় কানায় পূর্ণ হয়, পাউবো কর্তৃপক্ষ সে সময় এসে মেরামতের উদ্যোগ নেয়। এতে এক দিকে খরচ বাড়ে, অন্য দিকে তড়িঘড়িতে কাজ হয় নিম্নমানের। প্রতি বছরের মে মাস এলেই পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতের তোড়জোড় শুরু করে। কী কারণে তা কেউ বলতে পারে না। অথচ শীত মৌসুমে কাজ করার অনেক সুবিধা। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টির জন্য পাউবোর লোকজন অসময়ে এসে কাজ ধরেন।

সূত্র মতে, দেড় যুগের অধিক সময় ধরে নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে অসংখ্য রাস্তাঘাট, হাজার হাজার একর ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বহু স্থাপনা। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করতে না পারায় উপকূলের অনেক লোকালয়ে এখনো চলছে জোয়ার ভাটা। ফলে নদীর সাথে তালমিলিয়ে রীতিমতো জোয়ারভাটার মধ্যে বসবাস করছে উপকূলীয় দুর্গত জনপদের হাজার হাজার পরিবার। উপকূলের মানুষ বাধ্য হয়ে উঁচু বাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে দ্রুত স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে নদীতে বিলীন হয়ে যাবে উপকূলের অনেক গ্রাম। বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হলেও সাগর মোহনা আন্ধারমানিক নদীর অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ারে পানিভাঙন কবলিত অংশ দিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে। কাক্সিক্ষত ফসল পায়নি কৃষকরা। এ ছাড়া বন্ধ হয়ে যায় বাঁধসংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও পাউবোর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে উপকূলে ১২টি ইউনিয়নে বিভিন্ন নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে নদীর তীরবর্তী ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। বর্ষা মৌসুমের আগেই রাবনাবাঁধ, আন্দারমানিক ভাঙনে দিশেহারা নদী তীরবর্তী বাসিন্দার। ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হতে শুরু করেছে বসতভিটা আবাদি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কিন্তু এর মধ্যে পূর্ব গৈয়াতলা, লেমুপাড়া, চম্পাপুর, মঞ্জুপাড়া, মুন্সীপাড়া, নিজামপুর, জালালপুর, ধূলাসার, বালিয়াতলী, দেবপুর, নাচনাপাড়া, বড়কলবাড়ি, খ্রিষ্টানপাড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

উপকূলের বাসিন্দারা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিষয়টি জনপ্রতিনিধিদের জানালেও তারা শুধু আশ্বাস দেন। বাঁধ মেরামতে কেউ উদ্যোগ নেন না। বর্ষায় যখন জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে পড়ার উপক্রম হয়, তখন মেরামতে উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে এক দিকে কাজের ব্যয় বাড়ে, অন্য দিকে কাজ হয় নিম্নমানের। প্রায় সময় বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। জনপ্রতিনিধিদের দাবি, পরিকল্পিত ও স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতি বছর ভাঙন দেখা দেয়। এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের গাফিলতিই দায়ী।
গৈয়াতলা গ্রামের মাসুম বিল্লাহ বলেন, নদীর পানির চাপে গৈয়াতলা স্লুইসগেটের দুই পাশে বাঁধে ফাটল ধরিছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড তা মেরামত করতিছে না। সময়ের কাজ সময়মতো করলি আমাগে এত ভূগতি হতো না। গাঙের পানি যখন চরের নিচে থাকে, তখন কারও দেখা পাওয়া যায় না। যেই সময় গাঙের পানি বান্ধের কানায় কানায় আইসে ঠেকে, তখনই শুরু হয় ‘মিয়া সাহেবগে’ তোড়জোড়। এ পর্যন্ত যতবার বান্দ ভাঙিছে সব ওই সাহেবগের গাফিলাতির কারণেই ঘটিছে।’
বালীয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ বি এম হুমায়ুন কবির বলেন, চরবালীয়াতলী গ্রামের বাঁধটি প্রায় ধসে গেছে। এখন কোনো রকম আছে। দ্রুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে সামনে জোয়ারে ওই এলাকায় পানিতে প্লাবিত হবে।
মির্ঠাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবা উদ্দিন বলেন, বেড়িবাঁধ ইতোমধ্যে বাঁধের রিভার সাইডে জিওব্যাগ ফালাচ্ছে কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। এ জন্য পাথর ফালাতে হবে। ঝুঁকি থেকে যায়। সাময়িক কিছু দিন থাকতে পারে। ব্লক ফালালে বেড়িবাঁধ রক্ষা করা যাবে। বর্তমান রাস্তা করেছে তা আবার ফাটল ধরেছে।

মহিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী ফজলু গাজী জানান, এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষই মৎসজীবী। আবার কেউ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শুধু অমাবস্যা-পূর্ণিমাই নয়, জোয়ার ভাটাার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। পূর্বের বেড়িবাঁধ নেই। এখন কোনো রকম একটি বেড়িবাঁধ করেছে তা আবার বড় জোয়ার হলে ভেঙে যাবে ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।
নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া জানান, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মহিব্বুর রহমান সরেজমিন গৈয়াতলা বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেছেন, কিছু দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিবেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয সহকারী প্রকৌশলী মো: শাহ আলম জানান, পাউবোর পূর্ব গৈয়াতলা, লেমুপাড়া, চম্পাপুর, মঞ্জুপাড়া, মুন্সীপাড়া, নিজামপুর, জালালপুর, ধুলাসার, বালিয়াতলী, দেবপুর, নাচনাপাড়া, বড়কলবাড়ি, খ্রিষ্টানপাড়া, চরান্ডা, চরম মোন্তাজ, চালিতবুনিয়া বড় বাইশদিয়া বেড়িবাঁধের ২২টি স্পটে ৯.১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: রবিউল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং হয়েছে। তারা বলছেন বেড়িবাঁধগুলো পর্যায়ক্রমে মেরামত করা হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement