১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
লিবিয়ায় জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেল মিরসরাইয়ের দুই যুবক

‘চাপাতি নিয়ে দু’পাশে বসে বলতে বাধ্য করে এখানে বেশ ভালো আছি’

-


বছর খানেক আগে একই এলাকার লিবিয়া প্রবাসী শাহাদাৎ হোসেন ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করতে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার নানা প্রলোভন দেখাতে থাকেন মিঠুর মাকে। সংসারের অভাবের কথা ভেবে মা দেল আফরোজ বেগম রাজি হন ছেলেকে ইতালি পাঠাতে। এজন্য বাড়িতে বাবামাকে পাঠিয়ে আগাম দেড় লাখ টাকাও নিয়ে যান শাহাদাৎ হোসেন। পরে লিবিয়ায় থাকা শাহাদাতের নির্দেশনা মতে কাগজপত্র জোগাড় করে গত ২১ মার্চ দুবাই পৌঁছায়। বিমানবন্দরে শাহাদাতের লোকজন রিসিভ করে গাড়িতে তুলে গলি গুপচির ভেতর দিয়ে নেয়ার পর ছোট একটি কক্ষে তাদের ৩০-৩৫ জনকে একসাথে রাখে। সেখানে দুই দিন রেখে একটি ফ্লাইটে করে নিয়ে যায় মিসর। মিসরে বিমান বন্দর এলাকায় গুদাম ঘরের মতো একটি স্থানে ২৪ ঘণ্টা রেখে আরেকটি বিমানে তুলে নিয়ে যায় লিবিয়া। লিবিয়াতে পৌঁছার পরই বদলে যায় শাহাদাতের আচরণ। চাকরি দেয়ার কথা বললেই চলে মারধর। এ দিকে বাড়িতে ফোন করে করে ধাপে ধাপে আদায় করে নেন ছয় লাখ টাকা। এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর এলাকার মো: দিদারুল আলমের ছেলে আজমির হোসেন মিঠু ।
জানা গেছে, মোটা অঙ্কের বেতনের আশ^াসে ধারদেনা করে ছেলেকে লিবিয়া পাঠাতে পারলে সংসারের কষ্ট ঘুচবে। এমন আশায় ২৪ বছর বয়সী ছেলেকে প্রবাসে পাঠাতে ধারদেনা ও ঘরের গরু বিক্রি করে দফায় দফায় দালালের হাতে টাকা তুলে দেন দেল আফরোজ বেগম। কথা ছিল দুবাই, মিসর হয়ে ছেলেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দেবে তারা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সেখান থেকে যাবে ইতালি। অথচ বাড়ি থেকে বের হওয়ার ৪১ দিন পর লিবিয়ায় বন্দিদশা থেকে ন্যাড়া মাথায় কঙ্কালসার দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ছেলে মিঠু। সেই সাথে গেছে তার ধারদেনার ছয় লাখ টাকাও।
তার মতো একই চক্রের হাতে পড়ে সব হারিয়ে প্রাণে বেঁচে বাড়ি ফিরেছেন উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ আজম নগর এলাকার যুবক আবদুল্লাহ আল জোবায়ের (২৪)। এ ঘটনায় বাড়ি ফিরে আজমির হোসেন মিঠু বাদি হয়ে শাহাদাৎ হোসেন, তার ভাই আজাদ হোসেন, সজিব (২৮), আজিম, নুরুল করিম ও বিবি জহুরাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন।

জোবায়েরের দক্ষিণ আজমনগর এলাকার বাড়িতে কথা হয় মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে জীবন হারাতে বসা এ দুই যুবকের সাথে। তাদের একজন আজমির হোসেন মিঠু জানান, এক বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে পড়ালেখায় ইতি টানেন তিনি। এরপর বাড়ির পাশে বাবার চায়ের দোকানে সাহায্য করতেন।
মিঠু বলেন, লিবিয়া পৌঁছানোর পরই আমাদের সবার পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয়। বাড়ি থেকে ছয় লাখ টাকা আদায়ের পর শাহাদাৎ আমাকে চড়া দামে আরেক পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেন। একদিন সেই পক্ষের হাতে তুলে দিতে লিবিয়ার একটি মরুভূমিতে ফেলে আসে আমাকে। সেবার এক লিবীয় নাগরিকের সহায়তায় রক্ষা পেয়ে পরিচিত এক বাংলাদেশীর আশ্রয় নেই। খবর পেয়ে শাহাদাৎ আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসেন। এনে একটি কক্ষে আটকে রেখে আমি কেন পালিয়ে যেতে চেয়েছি তা বলে বলে ওর ছোট ভাই আজাদ হোসেন, সজিব ও আজিমসহ আরো কয়েকজন মিলে নিয়মিত মারধর করে। সেখানে আট দিন অনাহারে থাকার পর জানালার কাঁচ ভেঙে একদিন সেখান থেকে পালিয়ে যাই। অনেক কষ্টে ফোনে বিষয়টি বাড়িতে জানালে মা এলাকার ইউপি সদস্যের মাধ্যমে শাহাদাৎকে আমাকে বাড়িতে পাঠানোর অনুরোধ করেন। এরপর তারা আবার আমাকে খুঁজে বের করে এনে একদিন সড়কের পাশে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত গাড়ির নিচে ফেলে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। সেখানে এক লিবীয় চালক আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করালে সেখানে এক সপ্তাহ চিকিৎসা নেয়ার পর শাহাদাৎ আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান। বাড়িতে বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি আমার ওপর আরো ক্ষিপ্ত হন। অবস্থা বেগতিক দেখে একদিন লিবিয়ায় আমি ভালো আছি তা বোঝাতে দুই ভাই চাপাতি নিয়ে দু’পাশে বসে বাড়িতে ভিডিও কল করেন। আমাকে বলেন বলবি- এখানে বেশ ভালো আছিস তুই। আমি সেভাবে বলতে বাধ্য হই। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গত ৫ মে ন্যাড়া মাথায় মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ি আসি আমি। ফাঁদ পেতে মানুষ ধরা ওদের পেশা। আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই চক্রের হাতে প্রতারিত আরেক যুবক আবদুল্লাহ আল জোবায়ের বলেন, চট্টগ্রামের মহসীন কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বিরতি পড়ে আমার। শাহাদাতের ছোট ভাই চক্রের সদস্য আজাদ হোসেন আমার বন্ধু। ওর কথা বিশ্বাস করে এ পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমার বাবা কুয়েত প্রবাসী। বারইয়ারহাটে আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। আমাকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়া নিয়ে যায়। আজিমের সাথে যা হয়েছে তেমনি হয়েছে আমার সাথে। ওই চক্রের সদস্য অনেক। বাংলাদেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীরা ওদের টার্গেট।
এ বিষয়ে করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো: আজাদ উদ্দিন বলেন, লিবিয়া প্রবাসী শাহাদাৎ হোসেন একই এলাকার আজমির উদ্দিন মিঠুকে ভালো চাকরি দেয়ার কথা বলে লিবিয়া নিয়ে প্রতারণা ও অত্যাচারের বিষয়টি আমি জানি। আজিমিরকে দেশে ফেরাতে আমি ফোনে বেশ কয়েকবার শাহাদাতের সাথে কথা বলেছি। এ ঘটনায় আজমির বাদি হয়ে আদালতে মামলা করেছেন।
জানতে চাইলে আজিমের করা মামলাটির আইনজীবী অনিমেশ কুমার সোম বলেন, লিবিয়াতে জালজালিয়াতি ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন মর্মে একটি ফোজদারি মামলা দায়ের করেছি। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে সেটি তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement