১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পঞ্চগড়ে ১৫০০ বছরের প্রাচীন মহারাজার দীঘি

পঞ্চগড়ে ১৫০০ বছরের প্রাচীন মহারাজার দীঘি -

দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে অমরখানা ইউনিয়ন। পড়শি রাষ্ট্র ভারতের সীমান্তঘেঁষা এ এলাকায় ১৫ শ’ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ‘ভিতরগড় মহারাজার দীঘি’ অবস্থিত। ‘মহারাজার দীঘি’ দারুণ মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। এই ঐতিহ্যবাহী দীঘিটি পর্যটকদের বরাবরই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে। এই দীঘিটি পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে রাজস্ব খাতে প্রচুর আয় বাড়বে। কর্ম সংস্থান ও আয় বাড়বে জনসাধারণের মাঝে।
সূত্রে প্রকাশ, মহারাজার দীঘির আয়তন প্রায় ৫৪ একর জমি। এ জমির উপর সুপরিচিত মহারাজার দীঘিটি অবস্থিত। দীঘির আয়তন পাড়সহ উত্তর- দক্ষিণে ৮০০ গজ, এবং পূর্ব ও পাশ্চিমে ৪০০ গজ। পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। খরা মৌসুমে পানির গভীরতা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ফুট। বর্ষা মৌসুমে পানির গভীরতা আরো অনেক বলে স্থানীয়রা বিশ^াস করেন। ইতিহাস অনুযায়ী ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ২৫ কিলো মিটার এলাকাজুড়ে জলেশ্বর রাজার ভিতরগড় দুর্গ নগরী সীমানা ছিল। এটি ছিল রাজার রাজধানী। কামরুম বুরুন্জীতে রাজা জলেশ^রকে বলা হয়েছে পৃথু রাজা। মহারাজার দীঘি থেকে প্রায় ১৩৫ মিটার দূরে পৃথু রাজার বাড়ি ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। ভিতরগড় দুর্গ নগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশে, উত্তর-পশ্চিমাংশে এবং উত্তর পূর্বাংশ বর্তমান পড়শি রাষ্ট্র ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা। ধারণা করা হয় যে ষষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদী পথের উপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, সিকিম, ভুটান, আসাম, তিব্বত, কুচবিহার, চিন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সাথে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। রাজ্যের পরিচালনার সময় ভিতরগড়ে পৃথু রাজা নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ ও মন্দির। খনন করেন একটি বিশাল দীঘি। যা মহারাজার দীঘি নামে পরিচিতি। সময়ের ব্যবধানে পৃথু রাজা কিচক নামের অসাধু ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হলে নিজ পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় পরিবারপরিজনসহ মহারাজার দীঘির পানিতে আত্মহত্যা করেন। তার রক্ষীবাহিনী তাকে অনুসরণ করে। যার কারণে তখন পৃথু রাজার রাজত্বের অবসান ঘটে।
মহারাজার দীঘির ইট বাঁধানো ঘাট ছিল ১০টি। ঘাট ও ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত ছিল। সুউচ্চ পাড়ে সবুজ ডালপালাযুক্ত গাছগাছালি। বিরাজমান ছিল মনোরম নৈসর্গিক এক দৃশ্য। সুদীর্ঘ ২৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিরাজমান ঐতিহাসিক ভিতর গড় দুর্গ নগরীর দৃশ্যমান স্থাপনার অধিকাংশই কালের আবর্তন-বিবর্তনে হারিয়ে গেলেও এখনো টিকে রয়েছে ঐতিহাসিক মহারাজার দীঘি। বিশাল এই দীঘি দেখতে প্রতিদিনেই সেখানে হাজির হোন অসংখ্যক পর্যটক, ভ্রমণ পিয়াসি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ছাত্র/ছাত্রীসহ অসংখ্য মানুষজন।
দীঘির চার পাশে সবুজ চা পাতায় ভরা বাগান। ভারতের সীমানাসংলগ্ন কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, সবুজ গাছের নিবিড় ছায়া সবাইকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। প্রতি বছর শীতের মৌসুমে বিভিন্ন এলাকা থেকে পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়ায় ছুটে আসে হাজারো পর্যটক। এসব পর্যটকের বেশির ভাগই মহারাজার দৃষ্টিনন্দন দীঘিও না দেখে ফিরে আসেন না। দীঘিরপাড়ে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও বিস্তীর্ণ স্বচ্ছ জল রাশির ঢেউ আর নানা প্রজাতির পাখির কুজনে মোহিত হোন পর্যটকরা। দীঘির চার পাশে দৃষ্টিনন্দন সুউচ্চ প্রশস্ত পাড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। কেউবা নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ান দীঘির স্বচ্ছ জলে। শীত মৌসুমে দীঘির সবুজ গাছগাছালি ঘেরা মহারাজার দীঘিতে ছুটে আসে অতিথি পাখি। অতিথি পাখির কলকাকলিতে দীঘির পাড়ে তৈরি করে মনোমুগ্ধকর এক অনাবিল পরিবেশ। দীঘির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে প্রবেশপথের দুটি সিঁড়ি। প্রতি বছর ১লা বৈশাখে দীঘির পাড়ে মেলা বসে। মেলার সভা-সৌন্দর্য উপস্থিত হয়ে সব বয়সের সাধারণ মানুষ। ভিতরগড় মহারাজার দীঘির চত্বরজুড়ে যদি পর্যটক কেন্দ্র গড়ে তুললে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় জনসমাজে অর্থনৈতিক আয় বৃদ্ধি পাবে।
এলাকার সচেতন মানুষ মনে করেন, এখানে পর্যটক কেন্দ্র গড়ে তুললে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষজন ঘুরতে আসত। প্রাচীন এতিহ্যবাহী মহারাজার দীঘির ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে পারবে। মহারাজার দীঘিকে আরো আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে নতুন করে সংস্কার করে এটির সভাবর্ধনের কথা জেলা প্রশাসক মো: জহুরুল ইসলাম ভাবছে।


আরো সংবাদ



premium cement