শুধু ছবি নয়, বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেক ঘুরিয়ে দেয়ার গল্প
- সাঈদ চৌধুরী
- ১১ মে ২০২৪, ০২:১১
এই ছবি ২০২৪ সালের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার’ হয়েছে। যে ছবির মাধ্যমে গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা তুলে ধরার জন্য এ বছর পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে ইসরাইলি হামলায় নিহত পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট শিশু স্যালির লাশ আলিঙ্গন করছেন এক ফিলিস্তিনি নারী ইনাস আবু মামার। ২০২৩ সালে ১৭ অক্টোবর ছবিটি তুলেছেন রয়টার্সের ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ সালেম। তিনি ছিলেন হাসপাতালের মর্গে, যেখানে বাসিন্দারা পাগলপ্রায় হয়ে নিখোঁজ আত্মীয়দের সন্ধান করছিলেন।
এটা শুধু ছবি নয়, এই শতকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। মোহাম্মদ সালেম নিজের জীবন বাজি রেখে কলম আর ক্যামেরা হাতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন কিভাবে নির্মমতাকে বিশ্ববাসীর সামনে ফুটিয়ে তুলতে হয়। তার প্রতিটি ছবি বিস্ফোরণধর্মী। যার প্রভাব মানবমনের গূঢ়তম অন্ধকার প্রদেশে ঢুকেছে। মনস্তাত্ত্বিক নিষ্ঠুরতা শক্তিমত্তার সাথে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের চিন্তার বন্ধ্যাত্বের জায়গাটায় আঘাত করেছে। বিবেকবানদের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাদের বিপ্লব বোধ। আর এজন্যই সাহসী সাংবাদিকতার স্রষ্টা হিসেবে শুধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার নয়, দেশ দেশান্তরে তিনি পেয়েছেন লাখো কোটি মানুষের হৃদয় নিঙড়ানো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
পুলিৎজার পুরস্কার সাংবাদিকতার নোবেল হিসেবে খ্যাত। ১৯১৭ সাল থেকে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একটি বোর্ড এই পুরস্কার ঘোষণা করে। এবারের পুলিৎজার পাওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে গত সোমবার। এটি ১৩০টি দেশের ৩ হাজার ৮৫১ জন ফটোগ্রাফারের ৬১ হাজার ৬২টি এন্ট্রি থেকে নির্বাচিত। চিত্রকার সাহস, দক্ষতা ও সহানুভূতির জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
একটি ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র গাজার খান ইউনিসে শিশুটির বাড়িতে আঘাত করেছিল। শিশু স্যালি তার মা ও বোনের সাথে নিহত হয়েছিল। এভাবে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষকে খুন করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মতে গাজায় ফিলিস্তিনি মৃতের সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি নারী ও শিশু।
এই ছবিতে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার চরম রূপটা দেখেছেন বিশ্ববাসী। এটি একটি ‘ভয়ঙ্কর দুঃখজনক মুহূর্ত’। গাজা উপত্যকায় যা ঘটছে তার বিস্তৃত ধারণার যোগফল। এই চিত্রগুলো আজকের বিশ্বকে রূপদানকারী চাপের আখ্যানগুলোর একটি মর্মস্পর্শী প্রতিফলন হিসেবে কাজ করছে। আমাদের যুগের সবচেয়ে নির্মম ঘটনাগুলোর সারমর্মকে আবদ্ধ করেছে।
ছবিটি গোটা বিশ্বের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। একের পর এক বিমান হামলায় গাজাবাসীকে যেন নিশ্চিহ্ন করতে চাইছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ত্রাণ নিতে আসা অভুক্ত ফিলিস্তিনি ও ত্রাণকর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে দখলদার বাহিনী। তবে এটা শুধু ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞকে চিত্রিত করে না, তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালাদের মুখোশ উন্মোচন করছে। পৃথিবীতে বহু দেশের সরকার প্রধানকে এক ধরনের মানসিক রোগী হিসেবে জানান দিয়েছে।
পুলিৎজার পুরস্কারের জুরি বোর্ড বলেছেন, ছবিটি যত্ন এবং সম্মানের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে, যা অকল্পনীয় ক্ষতির একটি রূপক এবং আরিক আভাস দেয়। জুরিরা রয়টার্সের ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ সালেমের মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেছেন। জুরি মানুষের যন্ত্রণার প্রতি সংবেদনশীলতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। যুদ্ধের অসারতার নিন্দা করেছেন। তারা আশা করেন, এই স্বীকৃতি যুদ্ধের মানবিক মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াবে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ব্যাপারে।
শোকার্ত গাজান মহিলার মর্মান্তিক এই ছবি স্বাধীন জুরি দ্বারা নির্বাচিত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এবং সাহস এবং সততার সাথে আমাদের বিশ্বের বাস্তবতা নথিভুক্ত করে? এটি ফিলিস্তিনে ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞকে চিত্রিত করে। এমন ছবির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে রয়টার্স। এ ছাড়া ইলন মাস্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ‘ন্যাশনাল রিপোর্টিং’বা ‘জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে প্রতিবেদন’ বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে রয়টার্স। ‘দ্য মাস্ক ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ শিরোনামে ধারাবাহিক ওই প্রতিবেদনে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্স, নিউরালিংক ও টেসলায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে।
রয়টার্সের পাশাপাশি ন্যাশনাল রিপোর্টিং বিভাগে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্টও। যুক্তরাষ্ট্রের এআর-১৫ রাইফেল এবং দেশটিতে বিভিন্ন বন্দুক হামলায় এই অস্ত্রের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সংবাদমাধ্যমটি। এ ছাড়া ‘এডিটোরিয়াল রাইটিং’ (সম্পাদকীয়) ও ‘কমেন্টারি’ (মতামত) বিভাগেও পুরস্কার জিতেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
জেলবন্দী রাশিয়ার বিরোধী রাজনীতিবিদ ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলামলেখক ভøাদিমির কারা-মুর্জাকেও পুলিৎজার দেয়া হয়েছে। কারাগারে থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আলোচিত কিছু কলাম লেখার কারণে তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন। কারা-মুর্জা রাশিয়ায় ২৫ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে দেয়া এক বক্তৃতায় রাশিয়া ইউক্রেনে ‘যুদ্ধাপরাধ’ করছে বলে উল্লেখ করার পর তার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগ তোলে পুতিন প্রশাসন। তারপর থেকেই তিনি কারাগারে রয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সমালোচকদের মধ্যে তিনিই দীর্ঘতম সাজা পেয়েছেন।
পুলিৎজারে আরেকটি সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে ধরা হয় পাবলিক সার্ভিস (জনসেবা) অ্যাওয়ার্ডকে। এ বছর এই অ্যাওয়ার্ড নিজেদের দখলে রেখেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা নিউ ইয়র্কভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা প্রোপাবলিকা। আর ‘ব্রেকিং নিউজ’ বিভাগে এবার পুলিৎজার পেয়েছে লুকআউট সান্তা কজ নামের একটি নিউজ পোর্টাল।
এবারের পুলিৎজারে অভিবাসীদের নিয়ে ছবি প্রকাশ করে ‘ফিচার ফটোগ্রাফি’ বিভাগে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। ‘এক্সপ্লেনেটরি রিপোর্টিং’ (বিষদ ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন) ও ‘ইলাস্ট্রেটেড রিপোর্টিং অ্যান্ড কমেন্টারি’ বিভাগে পুরস্কার জিতেছেন দ্য নিউ ইয়র্কারের সাংবাদিকেরা। আর ‘ক্রিটিসিজম’ (সমালোচনা) বিভাগে পুরস্কার নিজেদের করে নিয়েছে দ্য লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস।
শত বছর আগে শুরু হওয়া সাংবাদিকতার নোবেল খ্যাত এই পুরস্কার কারা পাচ্ছেন তা দেখা জন্য অপোয় থাকেন গোটা বিশ্বের সাংবাদিক ও সাহিত্যিকরা। পুলিৎজার পুরস্কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছাপার সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে গোটা বিশ্বে সমাদৃত।
পুলিৎজার পুরস্কার এর জনক জোসেফ পুলিৎজার। তিনি ও উইলিয়াম হার্স্ট সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। সংবাদপত্র প্রকাশক পুলিৎজার নামের এই হাঙ্গেরীয়-মার্কিন সাংবাদিকই পুলিৎজার পুরস্কারের প্রচলন করেছিলেন। ১৯১১ সালের অক্টোবরে মৃত্যুর সময় পুলিৎজার নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ রেখে যান। তার অর্থের কিছু অংশ দিয়ে ১৯১২ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার স্কুল চালু হয়েছিল।
ওই বছর চালু হওয়ার কিছু বছর পর থেকে স্কলারশিপ দেয়া হয় সাংবাদিকতার ওপর। জোসেফ পুলিৎজারের রেখে যাওয়া অর্থের ২,৫০,০০০ (আড়াই লাখ) মার্কিন ডলার স্কলারশিপ দেয়া হয়, তা এখনো চলমান আছে। এই অর্থের মাধ্যমে ১৯১৭ সালের ৪ জুন প্রথম পুলিৎজার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়। মোট ২১টি ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার দেয়া হয়। নতুন সংযুক্ত হয়েছে সাংবাদিকতারই জনসেবা বিভাগ।
২১টি বিভাগে পুরস্কারটি দেয়া হয় তার মধ্যে সাংবাদিকতার েেত্র ১৪টি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে ৬টি ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটি পুরস্কার দেয়া হয়।
সাংবাদিকতার ১৪ ক্যাটাগরি : ১. পাবলিক সার্ভিস, ২. ব্রেকিং নিউজ রিপোর্টিং, ৩. তদন্তমূলক প্রতিবেদন, ৪. ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন, ৫. স্থানীয় প্রতিবেদন, ৬. জাতীয় প্রতিবেদন, ৭. আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, ৮. ফিচার রচনা, ৯. ভাষ্য, ১০. সমালোচনা, ১১. সম্পাদকীয় রচনা, ১২. সম্পাদকীয় কার্টুন নির্মাণ, ১৩. ব্রেকিং নিউজ আলোকচিত্র, ১৪. ফিচার আলোকচিত্র।
সাহিত্যের ৬ ক্যাটাগরি : ১. কল্পকাহিনী, ২. নাটক, ৩. ইতিহাস, ৪. জীবনী বা আত্মজীবনী, ৫. কবিতা, ৬. সাধারণ নন-ফিকশন সঙ্গীতের ১ ক্যাটাগরি : ১. সঙ্গীত
২১ বিভাগের পুরস্কার বিজয়ীদের একটি করে প্রশংসাপত্র ও নগদ ১৫ হাজার মার্কিন ডলার দেয়া হয়, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৬ লাখের বেশি। তবে ব্যতিক্রমী হচ্ছে জনসেবা ক্যাটাগরি। এই ক্যাটাগরিতে বিজয়ীদের প্রশংসাপত্রের পরিবর্তে স্বর্ণপদক দেয়া হয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা