বাড়তি মূল্যস্ফীতিতে কষ্টে নিম্ন আয়ের মানুষ
বিআইডিএসের জরিপ মিলছে না বিবিএসের সাথে- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১০ মে ২০২৪, ০০:০০
গত ডিসেম্বরে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ। ওই মাসে বিবিএসের হিসাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি জরিপের তথ্য উল্লেখ করে মহাপরিচালক বিনায়ক সেন এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাড়তি এ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসুবিধায় ছিলেন। আর সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, যারা ঋণখেলাপি হচ্ছে, দিনদুপুরে ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে, তাদের কেন সরাসরি ডাকাত বলেন না। ডাকাতদের তো ডাকাতই বলতে হবে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিআইডিএসে এক বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিনায়ক সেন বলেন, ‘ডিসেম্বরে বিআইডিএসের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য নিয়েছি। এরপর একটি পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। ‘বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন। বইটি লিখেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এবং বিশেষ অতিথি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান।
অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান ও পিআরআইয়ের পরিচালক বজলুল হক খন্দকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো: হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক মো: আখতারুজ্জামান এবং বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন।
সাধারণ মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস। তবে বিআইডিএস পৃথক পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করেছে। বিবিএসের সবশেষ হিসাবে, গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চ মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে। মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৪ এবং ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন জানান, তাদের কাছে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এরপর রয়েছে পোলট্রি মুরগির দাম। দেশের পোলট্রি খাদ্যের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। গত দুই বছরে আমদানি করা এসব খাবারের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। যা শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। বিনায়ক সেন মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সুদহার বাড়ানো বা এ রকম পৃথক পদক্ষেপ নিলে হবে না। এর সাথে শুল্ক কমানোসহ সমন্বিতভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন বলেন, পোলট্রি খাদ্যে শুল্ক কমানো প্রয়োজন। এটি কমানো হলে তা মাছ ও মুরগির মতো পণ্যের দাম কমাতে সহায়ক হবে। এতে মূল্যস্ফীতিও কমবে। এ খাতে শুল্ক কমিয়ে অন্য খাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুষ্ঠানে উপস্থিত অর্থনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা সব সময় নরম ভাষায় কথা বলেন। এটা ভালো। কিন্তু যারা ঋণ খেলাপি হচ্ছে, দিনদুপুরে ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে, তাদের কেন সরাসরি ডাকাত বলেন না। ডাকাতদের তো ডাকাতই বলতে হবে।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে এম এ মান্নান বলেন, এমন সব প্রকল্প নিয়ে আসা হয়, যেগুলোর জন্মই আজন্ম পাপ। এমন সব প্রকল্প বড় অর্থায়ন দিয়ে পাস করি আমরা। এগুলো নিয়ে বলা হয়, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ছে, সুনির্দিষ্টভাবে প্রকল্প ধরে কেউ কথা বলেন না। এগুলো নিয়ে আপনারা (অর্থনীতিবিদেরা) কথা বলবেন।
বিনায়ক সেন বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আনতে বহুদিন ধরে ব্যাংকিং কমিশন করার কথা বলা হচ্ছে। এখানে কেউ হাত দিচ্ছি না। ব্যাংকিং কমিশন না করলে অন্তত ব্যাংকিং কমিটি গঠন করা হোক। এ বিষয়ে এম এ মান্নান বলেন, আমাদের অবস্থা হয়েছে, চুন খেয়ে গাল পোড়ে, দই দেখে ভয় করে। জীবনে অনেক কমিশন দেখেছি। খুঁজে খুঁজে বুড়ো লোকদের, অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের পদপদবি দিয়ে বসানো হয়, বড় ভবনে জায়গা দেয়া হয়; কিন্তু ফল কী হয়? সুতরাং কমিশন নয়, সরাসরি সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ড. মসিউর রহমান বলেন, রফতানি প্রণোদনা বন্ধ করা হবে কি না- সেটি সরকার ভেবে দেখতে পারে। যদি এ প্রণোদনা বহাল রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে রফতানি খাতে ওই পণ্যের অবদান যাচাইয়ের ভিত্তিতে তা দেয়া যেতে পারে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় রফতানি খাত চিহ্নিত করে তারপর এ প্রণোদনা দেয়া উচিত। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করায় এ ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে। এখন এটিকে বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি এখন থেকে বাজারের সাথে মিল রেখে নিয়মিতভাবে মুদ্রার বিনিময়হার সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন।
ড. এম কে মুজেরী বলেন, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা যেন কয়েকটা গ্রুপের জন্য না হয়। ব্যাংকি খাত দিনকে দিন রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, রাজস্ব বাড়ার ঘটনায় এনবিআর একক কোন কৃতিত্ব নেই। ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকার। কাজেই আয় বেড়েছে। পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে হাত দিতে হবে। ব্যাংকগুলো এত দিন যেভাবে চলেছে, সেভাবে চলতে দিলে আমরা ঋণখেলাপি কমার আশা করতে পারি না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা