১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যুদ্ধের অবসান ছাড়া চুক্তি নয়, যুদ্ধবিরতিতে বাধা দিচ্ছেন নেতানিয়াহু : হামাস

-

- বন্দীদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে ইসরাইলে বিক্ষোভ
- দেশে-বিদেশে শিক্ষার্থী বিক্ষোভে রাজনৈতিক সঙ্কটে বাইডেন
- নতুন করে শিক্ষার্থী বিক্ষোভ জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও মেক্সিকোয়

ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে মিসরের রাজধানী কায়রোতে দ্বিতীয় দিনের মতো আলোচনা হয়েছে। এতে মধ্যস্থতা করছে কাতার ও মিসর কর্তৃপক্ষ। তবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বলেছে, গাজায় যুদ্ধের অবসান ছাড়া কোনো যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে না তারা। সংগঠনটি আরো বলেছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বাধা দিচ্ছেন নেতানিয়াহু। আলজাজিরা ও রয়টার্স।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। টানা প্রায় সাত মাস ধরে চলা নির্বিচার এই হামলার জেরে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। এর সাথে অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটিতে দেখা দিয়েছে তীব্র মানবিক সঙ্কট। এমন অবস্থায় গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে চলছে সর্বাত্মক চেষ্টা। যুদ্ধবিরতি অর্জনে চলছে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনাও। তবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বলেছে, গাজায় যুদ্ধের অবসান ছাড়া কোনো যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে না তারা। গতকাল রোববার এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি। যদিও ইসরাইলের সঙ্গে হামাস যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে এবং যেকোনো সময় এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসতে পারে বলে আগেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল। খবরে বলা হয়েছে, হামাসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা শনিবার গভীর রাতে জোর দিয়ে জানিয়েছেন, হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতির এমন কোনো প্রস্তাবে ‘কোনো পরিস্থিতিতেই একমত হবে না’ যেটাতে স্পষ্টভাবে যুদ্ধের সম্পূর্ণ সমাপ্তির কথা অন্তর্ভুক্ত থাকবে না।
এএফপি বলছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হামাসের ওই কর্মকর্তা ‘গাজায় আগ্রাসন বন্ধের বিষয়টি যুক্ত না করে’ কেবল বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে চুক্তি করার বিষয়ে ইসরাইলি প্রচেষ্টার নিন্দাও করেছেন।
হামাসের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘হামাস কোনো অবস্থাতেই এমন কোনো চুক্তিতে সম্মত হবে না, যেটাতে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসান এবং সমগ্র গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর প্রত্যাহার ছাড়া কোনো চুক্তিই হবে না।’ এর আগে ইসরাইলের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা শনিবার জানান, যুদ্ধের অবসান ঘটানোর যে দাবি হামাস করছে, তা ‘(যুদ্ধবিরতির বিষয়ে) চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে।’
ইসরাইলি কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, বন্দী চুক্তির কাঠামোর বিষয়ে ‘ইতিবাচক ইঙ্গিত’ পেলেই কেবল তারা কায়রোতে প্রতিনিধিদল পাঠাবে, যদিও এমন কিছু এখনো ঘটেছে বলে মনে হয়নি। ব্রিটেনের প্রকাশিত বিবরণ অনুসারে, সম্ভাব্য একটি চুক্তির প্রস্তাবের বিষয়ে হামাসের জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীরা। এই চুক্তি হলে ৪০ দিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনিদের বন্দীদের সাথে গাজায় আটক বন্দীদের বিনিময় করা হবে। অবশ্য হামাস কর্মকর্তা শনিবার মধ্য রাতে জানিয়েছেন, ‘কোনো ধরনের অগ্রগতি’ ছাড়াই এ দিনের আলোচনা শেষ হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, হামাস এ চুক্তিটিতে ‘সম্পূর্ণ এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির চুক্তি’ বলে একটি সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে অনুরোধ করেছে এবং ইসরাইল এখন পর্যন্ত এ বিষয়টি মানেনি। হামাসের ওই নেতা জানিয়েছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বাধা দিচ্ছেন।
বন্দীদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে ইসরাইলে বিক্ষোভ
এ দিকে বিবিসি জানায়, হামাসের হাতে বন্দীদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি চুক্তির দাবিতে শনিবার মধ্য রাত পর্যন্ত ইসরাইলে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। তেল আবিবে বিক্ষোভে অংশ নেয়া বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধবিরোধী স্লোগান দেন। বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে সঙ্ঘাত দীর্ঘায়িত করার জন্য অভিযুক্ত করেন। ইসরাইলে যে বিক্ষোভ হলো, তা ছিল একটি চুক্তির জন্য নেতানিয়াহু সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়তে থাকার সর্বশেষ নিদর্শন। বন্দীদের ইসরাইলে ফিরিয়ে আনার জন্য চাপের মুখে আছেন নেতানিয়াহু।
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইল হামলা চালায়। হামলাকালে তারা ২৫২ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ১২৮ জন এখনো বন্দী আছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৩৪ জন মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। তেল আবিবে শনিবারের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন নাটালি এলডোর নামের এক ইসরাইলি। নাটালি রয়টার্সকে বলেন, তিনি একটি চুক্তি সমর্থনে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। জীবিত, মৃতসহ সব বন্দীকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই সরকার পরিবর্তন করতে হবে। তেল আবিবের কিরিয়া সামরিক ঘাঁটিতে জড়ো হওয়া কিছু বিক্ষোভকারী প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিকে ক্ষুণœ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অভিযুক্ত করেন। এ ছাড়া অন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানান।
অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পর বেশ কয়েকটি দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ইসরাইলবিরোধী আন্দোলন। গত মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার প্রথম এই বিক্ষোভ শুরু হয়। একপর্যায়ে তা দেশটির অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে। পরে তা কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে বিস্তৃত হতে শুর করে।
দেশ-বিদেশে এমন পরিস্থিতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নতুন এক অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। বাম ও ডান দুই মেরু থেকেই চাপে পড়েছেন বাইডেন। বামপন্থীরা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চান, শান্তি চান। আবার মার্কিনরা মনে করছেন, ক্যাম্পাসগুলোয় নজিরবিহীন এমন বিক্ষোভ শিক্ষার পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করছে। শান্তিশৃঙ্খলা নষ্টের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে দুই হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার রাতে লস অ্যাঞ্জেলেসে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় ইসরাইলপন্থীদের মুখোশধারী একটি গোষ্ঠী বিক্ষোভকারীদের তাঁবুগুলোর ওপর হামলা চালায়। বাতিল হয়ে যায় ক্লাস। ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা হয়। পুলিশ এসে বিক্ষোভকারীদের তাঁবু উঠিয়ে দেয়। অনেকটা একই চিত্র দেখা গেছে নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিক্ষোভকারীরা একটি প্রশাসনিক ভবন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। পরে পুলিশ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের ও তাদের তাঁবুগুলো সরিয়ে দেয়। আটক হন অনেকেই। এমন এক সময়ে এই অশান্ত পরিবেশ দেখা দিয়েছে যখন গাজায় যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে।
জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও মেক্সিকোয় বিক্ষোভ
এএফপি জানায়, গাজায় ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী বিক্ষোভ আরও নতুন নতুন দেশে ছড়িয়েছে। ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধের দাবিতে গত ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভ পরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চলমান বিক্ষোভ একপর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই তালিকায় যুক্ত হয় ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, ভারত ও লেবাননের নাম। নতুন করে যেসব দেশে শিক্ষার্থী বিক্ষোভ ছড়িয়েছে, এর মধ্যে আছে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও মেক্সিকো। গত শুক্রবার জার্মানির বার্লিনের হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্য জায়গায় ক্যাম্প করতে বিক্ষোভকারীরা অস্বীকৃতি জানান। এর পরই পুলিশ বেশ কিছু বিক্ষোভকারীকে জোর করে সরিয়ে দেয়। বার্লিনের মেয়র কাই ওয়েগনার এই বিক্ষোভের সমালোচনা করেছেন। তিনি এক্সে (সাবেক টুইটার) বলেছেন, এই শহর (বার্লিন) যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সের মতো ঘটনা দেখতে চায় না।
আয়ারল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের শিক্ষার্থীরা শুক্রবার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। তারা তাদের এই প্রতিবাদী কর্মসূচিকে ফিলিস্তিনের সাথে সংহতি হিসেবে বর্ণনা করেন।
মেক্সিকোর বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ইউএনএএমের বেশ কিছু শিক্ষার্থী গত বৃহস্পতিবার দেশটির রাজধানীতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। তারা নানা স্লোগান দেন। এসব স্লোগানের মধ্যে ছিল ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ ও ‘নদী থেকে সমুদ্র, ফিলিস্তিন হবে মুক্ত’। মেক্সিকোর এই বিক্ষোভকারীরা চান, দেশটির সরকার ইসরাইলের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করুক। সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবনের প্রবেশদ্বার বৃহস্পতিবার থেকে দখল করে আছেন প্রায় ১০০ শিক্ষার্থী। বিক্ষোভকারী এই শিক্ষার্থীরা ইসরাইলকে একাডেমিক বয়কট এবং গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচি আজ সোমবার পর্যন্ত চলবে।


আরো সংবাদ



premium cement