১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
টঙ্গীতে কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচার

বাড়িঘর বিক্রি করে অন্যত্র চলে যেতে চাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা

-


টঙ্গী মরকুন গোরস্থানকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং এখন সবার আতঙ্ক। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দারা জায়গাজমি, বাড়িঘর বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। অনেকে ইতোমধ্যে বাড়িঘর ভাড়া দিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এ কিশোর গ্যাং পঙ্গপালের মতো ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের এলাকায়। ঝাঁকবেঁধে এরা যে কারোর ওপরই হানা দিচ্ছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয় এদের কাছে।
এলাকাবাসী জানায়, মূলত মাদককারবারকে কেন্দ্র করে মরকুন গোরস্থানকেন্দ্রিক গড়ে ওঠে আলোচিত কিশোর গ্যাং। এরা এলাকায় জামাল-ফজল বাহিনী এবং গোরস্থান কিং নামেও সমধিক পরিচিত। কবরস্থানের বেড়া খুলে নিয়ে বিক্রি করে দেয়াসহ মাদককারবার, ইভটিজিং, বাড়ি, জায়গাজমি দখল, কারখানায় হামলা, ছিনতাই, চুরিসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। এ বাহিনীতে রয়েছে প্রায় ২০ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ। নেতৃত্বে রয়েছে জামালের ছেলে সাইফ ও ফজলের ছেলে হিরা। এ ছাড়া রোমান ও ইমন নামের দুই কিশোর এ বাহিনীর বহিরাগত সদস্যদের নেতৃত্বে। এরা কবরস্থানের ভেতর মাদক সেবনের আস্তানা গড়ে তুলেছে। সেখানে মাদককারবার ছাড়াও আশপাশের রাস্তায় অস্ত্রের মুখে গার্মেন্টশ্রমিকদের বেতনের টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। সুযোগ পেলেই মানুষের বাসাবাড়ি ও মিল ফ্যাক্টরির মূল্যবান জিনিসপত্রও লুটে নেয়। এমনকি মরকুন গোরস্থানে নতুন কবরের বেড়া খুলে নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়। কেউ প্রতিবাদ করলে এরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এলাকায় মহড়া দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে। বিকট শব্দের হলারযুক্ত মোটরসাইকেল দাপিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মরকুন বাবুল সরকারের বসতবাড়িতে হামলা চালায় জামাল-ফজল বাহিনীর কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এ সময় বাড়িঘরে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। রড দিয়ে বাবুল সরকারের মা ফিরোজা বেগমকে (৬৫) পিটিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় বাবুল সরকার বাদি হয়ে টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। গত ২ মার্চ কিশোর গ্যাং সদস্যরা হামলা চালায় স্থানীয় টেকপাড়ার ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নানের বাড়িতে। এতে আব্দুল মান্নান ও তার ছেলে শাহাবুদ্দীন গুরুতর আহত হন। এদের ভয়ে তিনি থানায় অভিযোগ করারও সাহস পাননি। সম্প্রতি কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য সাইফ, রোমানসহ কয়েক সহযোগী মরকুন পাগাড় লিংক রোডে পোশাক প্রস্তুতকারক উইন্ডি গ্রুপের সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপ থেকে রড-সহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি করার সময় কারখানার নিরাপত্তাপ্রহরীর হাতে ধরা পড়ে। এ ঘটনার জের ধরে ওই দিনই উইন্ডি গ্রুপের ওয়ার্কশপে হামলা চালায় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এ সময় ওয়ার্কশপের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায় তারা। কুপিয়ে আহত করে নিরাপত্তাপ্রহরী হামিদুলকে। এ ঘটনায় আরো দু’জন শ্রমিক আহত হন। এ ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষ টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়াও গত বছর কর্নেল নজরুল ইসলামের বাড়ির ভাড়াটিয়া বেদে সম্প্রদায়ের এক যুবকের মাথা ফাটিয়ে দেয় জামাল-ফজল বাহিনী। পরে বিচার না পেয়ে ভয়ে সে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এ ছাড়াও মরকুন কবরস্থানের গোরখোদক গাজীর বাড়িতেও হামলা চালায় জামাল-ফজল বাহিনী। কিশোর গ্যাং সদস্যরা সম্প্রতি কবরস্থান মোড়ে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয় শরিফ নামের এক যুবকের। চিকিৎসা শেষে শরিফ থানায় অভিযোগ দিলে পরে সন্ত্রাসীদের হুমকিতে অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হন। গত ১৫ জানুয়ারি জামাল-ফজল বাহিনী মৃত তৈয়ব আলীর বাড়ি ও দোকানপাট ভেঙে লুটপাট চালায়। এ বিষয়ে তৈয়ব আলীর ছোট ছেলে সোলায়মান গাজী বাদি হয়ে টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
সম্প্রতি এ বাহিনীর এক সদস্য র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এ-সংক্রান্তে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হয়। প্রকাশিত ওই সংবাদ নিজের ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করেন পত্রিকাটির সাংবাদিক আল-আলিম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যরা সাংবাদিক আল-আমিনদের টঙ্গী মরকুনের বাড়িতে গত ১ মার্চ হামলা চালায়। হামলায় সাংবাদিক আল-আমিনের বৃদ্ধা মা আহত হন। ঘটনার সময় আল-আমিন বাড়িতে ছিলেন না। পরে তিনি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে টঙ্গী পূর্ব থানায় জিডি করেন। এ জিডির কথা জানতে পেরে গত ৪ এপ্রিল রাত ২টায় হেলমেট, মুখোশ, পিপিই ও সিকিউরিটি পোশাক পরে আল-আমিনদের বাড়িতে সর্বাত্মক হামলা চালায় জামাল-ফজল বাহিনী। সন্ত্রাসীরা প্রথমেই বাড়ির সব সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। এ ঘটনায় সাংবাদিক আল-আমিন বাদি হয়ে টঙ্গী পূর্ব থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় এ বাহিনীর প্রধান জামাল, ফজল ও সহযোগী রেজাউল।

বর্তমানে এরা জামিনে ছাড়া পেয়ে সাংবাদিক আল-আমিনকে হত্যাসহ তার পরিবারকে এলাকা থেকে উৎখাতের হুমকি দিচ্ছে। সাংবাদিক আল-আমিন বলেন, এই এলাকা এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আমরা অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য বাসা খুঁজছি। আমার মা সব সময় আতঙ্কে থাকেন। বাড়িঘর, জায়গাজমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য মা চাপ দিচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, পাশের কালীগঞ্জ থানার নাগরী ইউনিয়নের জনৈক আলমগীর হোসেন বিভিন্ন অপকর্মের কারণে নিজ এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে বেশ কয়েক বছর আগে মরকুন টেকপাড়ায় বাসা ভাড়া নেন। দৃশ্যত তার কোনো ব্যবসাবাণিজ্য বা আয়ের উৎস না থাকলেও রাজকীয় জীবন যাপন করেন। তিনিই নেপথ্যে থেকে আলোচিত কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। গ্রেফতার হলে জামিনে ছাড়িয়ে আনছেন।
এ ব্যাপারে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো: ইব্রাহিম হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যদের কোনো ছাড় নয়। এদেরকে গ্রেফতারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। সাংবাদিক আল-আমিনদের বাড়িতে হামলায় জড়িত আসামিদের আমরা ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছি। কিশোর গ্যাং নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলবে।


আরো সংবাদ



premium cement