চলনবিলের ২৫ নদী ভুগছে দখল দূষণ ও নাব্যতা সঙ্কটে
- মো: নূরুল ইসলাম চাটমোহর (পাবনা)
- ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১০, আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫৪
শুকিয়ে গেছে চলনবিল এলাকার নদ-নদীগুলো। বছরের পর বছর খনন না করায় এ এলাকার নদ নদীগুলো ভুগছে নাব্যতা সঙ্কটে। ফলে সেচ কার্য ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি দেশী মৎস্য সম্পদও আজ বিলুপ্তির পথে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্যেও। চলনবিল এলাকার নদীনালা হারিয়েছে পূর্ব জৌলুশ ও স্বকীয়তা। অধিকাংশ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সেসব নৌরুটের নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা। জলপথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হলেও বর্তমান সময়ে এ এলাকার সব জলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিক খরচে ব্যবসায়ীদের স্থলপথে পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে।
অধ্যক্ষ মো: আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ সূত্রে এবং চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমানের সাথে কথা বলে জানা যায়, জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া আত্রাই নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পরে। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ি, নন্দনালী ও নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নিম্ন হতে ‘আত্রাই’ ও ‘গুড়’ নামে দুই ভাগ হয়ে যায়। গুড় নদী নাটোরের সিংড়া পর্যন্ত চলে আসে। অপর দিকে আত্রাই নদী একান্ন বিঘা, যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় বাঁশের বাজার এলাকায় এসে বড়াল নদের শাখা নন্দ কুজার সাথে মিশেছে। এদের মিলিত ¯্রােত গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বওশা এলাকার ভাটিতে গিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়। একটি ভাগ অষ্টমনিষা হয়ে ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা নামক স্থানে বড়ালে মিশেছে। গুমানী নদীর অপর ভাগ নূরনগরে বড়াল নদীর সাথে মিশেছে। ১৭৮৭ সালে তিস্তার সাথে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। জলপাইগুড়ির উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ নিমগাছী তাড়াশ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনিষার কাছে গুমানী নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েক জায়গা মরে যায়। বগুড়া শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ভেতর দিয়ে বাঘাবাড়ি ব্রিজের এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে এসে করতোয়া বড়াল পয়েন্টে হুরাসাগরের সাথে মিশেছে। রায়গঞ্জের নিম্নাংশ থেকে এটি ফুলজোড় বা বাঙালি নদী নামেও পরিচিত। রাজশাহীর চারঘাট থেকে পদ্মার অন্যতম প্রধান শাখা নদ বড়াল রাজশাহীর বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরের সাথে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সাথে মিশেছে।
১৯৮৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত বড়াল নদটি স্রোতস্বিনী থাকলেও ১৯৮৫ পরবর্তী সময়ে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে স্লুইসগেট ও ক্রসবাধ দেয়ায় এ নদীটি এখন মৃতাবস্থায় পরে আছে। ২০০৮ সাল থেকে এ নদী উদ্ধারে বড়াল রক্ষা আন্দোলন ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করে আসার ফলশ্রুতিতে চাটমোহর নতুন বাজার, বোঁথরঘাট ও রামনগরের ঘাটের তিনটি ক্রসবাঁধ অপসারণ করা হলেও এখনো পদ্মার সাথে যমুনার সংযোগ ঘটানো সম্ভব হয়নি। আশার কথা চারঘাট স্লুইসগেট থেকে এক হাজার ৮০০ মিটার এলাকা খনন করে পদ্মার সাথে সংযোগ করা হয়েছে। কিন্তু চারঘাটে স্লুইসগেট থাকায় এবং ২২০ কিলোমিটার বড়ালের অধিকাংশ স্থান দখলদারদের কবলে থাকায় এবং ব্যাপক দূষণের ফলে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। চাটমোহরের ক্রসবাঁধগুলো অপসারণের ফলে বর্তমান সময়ে চাটমোহর থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বর্ষায় কিছু দিনের জন্য প্রাণ ফিরে পায় নদটি। চেঁচুয়া নদী ধারাবারিষার দক্ষিণপাশ দিয়ে চতরার বিল, জোড়দহ, আফরার বিল, খলিশাগাড়ি বিল ও কিনু সরকারের ধর হয়ে চরসেনগ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীর সাথে মিশেছে। এ নদীটিও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় স্লুইজগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকি ৮ মাস পানিশূন্য থাকে নদীটি। দখল দূষণের ফলে বানগঙ্গা, তুলসী নদী, ভাদাই নদী, মরা আত্রাই নদীসহ চলনবিলের ২৫ নদীর বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ।
নদী শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা যমুনা নদী হয়ে ঢাকা থেকে যেসব পণ্য নৌপথে আনতেন এখন তা পারছেন না। সড়কপথে পণ্য পরিবহনে তাদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। ক্রেতারাও বিভিন্ন হাটবাজার থেকে পণ্য কিনে নৌপথে বাড়িতে নিতে পারছেন না। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মৎস্যজীবী। পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন তারা। পূর্বে নদী থেকে কৃষক অগভীর নলকূপের সাহায্যে বোরোক্ষেতে পানি সেচ দিতে পারলেও এখন তা পারছেন না। উপরন্তু পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর পাম্প মালিকরা মৌসুমের শুরুতেই তাদের সেচপাম্প সমতল থেকে অন্তত ১০ ফিট নিচে স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আত্রাই রিভার ড্রেজিং কাজ শুরু হলেও সেখানে অনিয়মের প্রশ্ন ওঠে শুরু থেকেই। যেখানে বালু পাওয়া সম্ভব এমন কিছু এলাকা খনন করে সংশ্লিষ্টদের অর্থের বিনিময়ে বালু বিক্রি করতে দেখা যায়।
চাটমোহর সরকারি কলেজের পরিবেশবিদ ড. এস এম মুক্তি মাহমুদ জানান, ভৌগোলিকভাবে এ এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো নদীর জীবন চক্রের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ বার্ধক্য অবস্থায় উপনীত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, চলনবিল এলাকার নদীর তলদেশের ঢালের পরিমাণ কম, নদীর প্রবাহমান পানির পরিমাণ কম, ¯্রােতের বেগও কম। উৎসস্থান থেকে নদীগুলোর দূরত্ব অধিক হওয়ায়, পানির সাথে প্রবাহিত মৃত্তিকা কনা বালুকনা, নূড়িকনা এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনার পরিমাণ বেশি ও নদীর তলদেশে তা সঞ্চয়নের পরিমাণ ও অধিক হওয়ায় ক্রমশই নদী উপত্যকার পানি ধারণক্ষমতা কমে আসছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো একেবারেই শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের খাদ্য শৃঙ্খল ব্যাহত হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ফসল উৎপাদনসহ পানি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বিপর্যয় ঘটছে সার্বিক পরিবেশেরও।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান আরো জানান, নদ-নদী খাল-বিল চলনবিলের প্রাণ। অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইসগেট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ এবং দখল দূষণের ফলে চলনবিল এলাকার ২৫ নদ-নদীর করুণ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বেশির ভাগ নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে পরেছে। এগুলো রক্ষা করতে না পারলে চলনবিল তার স্বকীয়তা হারাবেই। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে এ এলাকার নদ-নদী রক্ষায় আন্দোলন করে আসছি। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তবেই বাংলাদেশের বৃহৎ বিল, ঐতিহ্যবাহী চলনবিল এবং এর অন্তর্ভুক্ত ২৫ নদী প্রাণ ফিরে পাবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা