লক্ষ্মীপুরে নোমান-রাকিব হত্যার ১ বছরেও প্রধান আসামি জেহাদি অধরা
- লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা
- ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৯
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুরে গত এক বছর আগে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল-নোমান এবং ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমাম। জোড়া এ হত্যাকাণ্ডটি দেশব্যাপী আলোচিত একটি ঘটনা ছিল।
ঐ হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী করা হয়েছে জেলার শীর্ষ একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান আবুল কাশেম জেহাদিকে। তাকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
তবে ঘটনার এক বছর পার হয়ে গেলেও পুরোপুরি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে প্রধান অভিযুক্ত সন্ত্রাসের গডফাদার খ্যাত জেহাদি। ঘটনার পর পরই তার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য গ্রেফতার হলেও এখন তারা জামিনে বাইরে আছেন।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি সে সময় দেশব্যাপী সর্বোচ্চ আলোচনার জন্ম নিলেও কয়েক মাসের মাথায় আলোচনা অনেকটা চাপা পড়ে যায়। মূল অভিযুক্ত জেহাদি গ্রেফতার না হওয়ায় অসন্তোষ নিহতের পরিবারের সদস্যদের।
আর মামলার বাদি নিহত যুবলীগ নেতা নোমানের বড়ভাই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানও রয়েছেন নিরাপত্তা হীনতায়।
নিহত আবদুল্লাহ আল নোমান বশিকপুর ইউনিয়নের উষিয়াকান্দি গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তাকে ওই সময় জেলা আওয়ামী লীগের নবগঠিত কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক রাখা হয়। তিনি দুই ছেলের জনক ছিলেন।
আর রাকিব ইমাম ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি একই ইউনিয়নের নন্দীগ্রামের রফিকউল্যার ছেলে।
গত বছরের ৫ এপ্রিল ওমরাহ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরবে যান যুবলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান। ২০ এপ্রিল দেশে ফিরে দু’দিন ঢাকার বাসায় থেকে ঈদের দিন (২২ এপ্রিল) গ্রামের বাড়িতে আসেন নোমান। গ্রামে আসার পরই সন্ত্রাসীরা তাকে টার্গেট করে। তিন দিনের মাথায় অনেকটা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। সাথে থাকা ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামকেও হত্যা করা হয়।
২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন আবুল কাশেম জেহাদি। আর যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমানও প্রার্থী হন। নির্বাচনে নৌকার পরাজয়ে মাহফুজুর রহমান বিজয়ী হন। নির্বাচিত হয়ে মাহফুজুর রহমান ছোটভাই নোমানের সহায়তায় এলাকায় জেহাদি ও তার বাহিনীর চাঁদাবাজি এবং মাটি দস্যুতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এক দিকে নির্বাচনে পরাজয়, অন্য দিকে এলাকায় প্রভাব বিস্তার সঙ্কটে পড়ে জেহাদি বাহিনী। এ দুই ইস্যুতে টার্গেটে পড়েন যুবলীগ নেতা নোমান। ফলে জেহাদির নির্দেশে নোমানকে হত্যা করা হয়। আর তার সঙ্গে থাকায় রাকিবও হত্যার শিকার হন।
ঘটনার পরপরই পুলিশ ও রথ্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত আসামিদের জবানবন্দীতে এমন তথ্য উঠে আসে। আর হত্যাকাণ্ডের পর নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমান জেহাদি ও তার বাহিনীকে দায়ী করেন।
অধরা থেকে যায় জেহাদি, অন্য আসামিরা জামিনে- ঘটনার পরদিন নোমানের ভাই ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বাদি হয়ে চন্দ্রগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে আবুল কাশেম জেহাদিকে প্রধান আসামি করে ১৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ১৪-১৫ জনকে বিবাদি করা হয়। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ এবং র্যাবের হাতে মামলার এজাহারভুক্ত ১১ জন আসামি ও সন্দেহভাজন আরো ১১ জন আসামি গ্রেফতার হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামিরা জামিনে রয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান।
তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, মামলার প্রধান আসামি কাশেম জেহাদিসহ এজাহারনামীয় চারজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। কাশেম জেহাদির অবস্থানও জানা যাচ্ছে না। কিছুদিন ভয়েস পাঠিয়ে বিভিন্নজনকে হুমকি-ধমকি দিলেও এখন তা হচ্ছে না। মামলার তদন্ত এখনও চলমান। ঘটনার বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আরো অনেক তথ্য পাওয়া বাকি আছে। তথ্য উদঘাটন শেষ হলে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করা হবে।
প্রাণ নিয়ে শঙ্কিত মামলার বাদিসহ নিহতদের পরিবার
মামলার বাদি মাহফুজুর রহমান প্রতিনিয়ত তার প্রাণ নিয়ে শঙ্কায় আছে। থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন তিনি।
মাহফুজুর রহমানের অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিরা জামিনে বের হয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দলীয় আইনজীবীরা অপরাধীদের জামিনে বের করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। তাদের হাত ধরেই অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। জেহাদিও আটক হয়নি। প্রথম থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হত্যাকারীদের আটক করতে যেভাবে তৎপর ছিল, সেটি কমে গেছে। জেহাদির নির্দেশ ও দিকনির্দেশনায় জামিনে আসা আসামিরা এখন সঙ্ঘবদ্ধ। জেহাদি অজ্ঞাত স্থানে ভয়েজ মেসেজ পাঠিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে এখনো চাঁদা দাবি করছেন। রাকিবের ভাই রুবেলকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান আসামি জেহাদি গ্রেফতার না হলেও এলাকায় তার প্রভাব রয়েই গেছে। তার বাহিনীর যেসব সদস্য রয়েছে, শুরুতে তারা প্রকাশ্যে না থাকলেও এখন এলাকায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে আছেন। আর ঘটনার পর জেহাদি বিভিন্ন লোকজনকে মোবাইলফোনে ভয়েজ পাঠিয়ে হুমকি দিত। এসব কারণে হত্যার বিচার নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে যে আন্দোলন ছিল, তা পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়।
বাদি মাহফুজুর রহমান বলেন, সবারই জীবনের ভয় আছে। জেহাদির হাতে প্রাণ হারানোর ভয়ে এখন সবাই চুপ হয়ে আছে।
আসামিদের সাজা নিয়ে সংশয় খোদ সংসদ সদস্যের
সম্প্রতি প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় চন্দ্রগঞ্জের ছাত্রলীগ নেতা এম সজীব। তার নামাজে জানাজায় অংশ নিয়ে লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, নোমান-রাকিব হত্যা মামলাটি যে অবস্থায় আছে, তাতে হত্যাকারীদের সাজা হবে বলে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমি প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। ওই মামলা যে অবস্থাতে আছে তাতে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমপির এমন শঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (পরিদর্শক) নিজাম উদ্দিম ভূঁইয়া বলেন, এমপি কিভাবে কী বলেছেন, তা তার ব্যক্তিগত কথা। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে কিছুই জানানো হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ
হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার না হওয়া এবং অগ্রগতি না থাকায় গত ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন নিহত নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমান, রাকিবের বাবা রফিক উল্যা ও ভাই সাইফুল ইসলাম রুবেল। এ সময় তারা মামলার অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানান। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করেছেন বলে জানায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা।
হত্যা মামলার অগ্রগতি এবং বশিকপুরের আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ অনেক কাজ করেছে। শুরুতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সিনিয়র অফিসাররা মাঠে ছিলাম। এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা তদন্তাধীন আছে। চেষ্টা করছি মামলাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত যেন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ।
তিনি বলেন, বশিকপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। পুলিশ ক্যাম্প আছে, সেখানে পর্যাপ্ত অফিসার ও ফোর্স রাখা আছে। ওই সব এলাকায় আমাদের পর্যাপ্ত নজরদারি আছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা