নৈতিকতার প্রশিক্ষণ দেবে ঢাবি নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্র
- ঢাবি প্রতিবেদক
- ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
নৈতিকতা হলো- উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিত এর পার্থক্যকারী। যা নির্দিষ্ট কোনো আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে। আবার এটি সেসব বিষয় হতেও আসতে পারে যেগুলো সব মানুষ কল্যাণকর হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও কবি অস্কার ওয়াইল্ডের মতে, নৈতিকতা কেবল সেই মনোভাব যেখানে আমরা এমন ব্যক্তিদের গ্রহণ করি যাদেরকে আমরা ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকেন পড়াশোনা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজে। ফলে সবার পক্ষে নৈতিকতার পর্যাপ্ত চর্চা করা হয়ে ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বিভাগেও নেই শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শিক্ষার কোনো বিশেষায়িত কোর্স।
ফলে পারিবারিক ও ধর্মীয় মাধ্যমে শিখে আসা এবং স্কুল-কলেজের সীমিত নৈতিক শিক্ষার বাইরে অনেকটা অ্যাকাডেমিক নৈতিক উন্নয়ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিতই থাকেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা। অথচ তারাই একসময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ পালন করে থাকে। ফলে তাদের অনেক বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া উচিত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকলেও একেবারে হতাশ হওয়ারও সুযোগ নেই। ঢাবি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার চাহিদা পূরণে আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হয়েছে একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর মরেল ডেভেলপমেন্ট (সিএমডি)’ বা নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্র।
জাতীয় ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে চলমান নৈতিকতার সঙ্কট উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনে গবেষণা পরিচালনা, সমাজের অনৈতিকতা দূর করে নৈতিকতা উন্নয়নে কাজ করা ও জনগণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গবেষণা কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের নৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। নৈতিকতা বিষয়ে মাসিক/ত্রৈমাসিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, কর্মশালা, নৈতিক উন্নয়নবিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ, প্রবন্ধ আলোচনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা মুলত এই কাজটি করছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীই নয় বরং এর মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বাইরের যেকোন শ্রেণিপেশার মানুষ। শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বিচারক, পরিবেশবিদ, চিকিৎসকসহ সবার জন্য এই গবেষণা সেন্টারের দ্বার সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত।
নিয়মানুযায়ী, তিন বছরের জন্যে নৈতিকতা উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক হন দর্শন বিভাগের শিক্ষক শিক্ষিকাদের মধ্য যিনি প্রবীণতম। এরপর তা ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন হতে থাকে। তবে কোনো শিক্ষক যদি দর্শন বিভাগের চেয়ারপারসন অথবা গোবিন্দদেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের পদে নিয়োগপ্রাপ্ত থাকেন তাহলে তিনি একইসাথে এই কেন্দ্রের পরিচালক হতে পারবেন না। সেই ধারাবহিকতায় কেন্দ্রটির বর্তমান পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক আবুল খায়ের মোহাম্মদ ইউনুস (এ কে এম ইউনুস)। পদাধিকার বলে এই কেন্দ্রের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে এই কেন্দ্রের পরিচালক, দর্শন বিভাগের চেয়ারপারসন, গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক এবং দর্শন বিভাগের অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্য থেকে তিনজন প্রবীণ শিক্ষক সদস্য হিসেবে থাকেন।
এ ছাড়া আরো দু’জন সদস্য থাকেন, যাদের একজন দর্শন বিভাগ ছাড়া কলা অনুষদের অন্য কোনো বিভাগ থেকে এবং অপর একজন সদস্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কোনো একটি বিভাগ থেকে নিয়োগ পান। দর্শন বিভাগ বহির্ভূত এ দু’জন সদস্য দুই বছর মেয়াদের জন্য নিয়োগ পান। কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এই দু’জন সদস্যের নাম মনোনয়ন করা হয়। বর্তমান কমিটির এই দু’জন সদস্য হলেন- বাংলা বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান এবং অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান (কিছুদিন আগে তিনি মারা যাওয়ায় এই পদটি এখন শূন্য)। নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্র সাধারণত নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায়োগিক নীতিবিদ্যা বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং নৈতিকতা বিষয়ে সবারই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে।
ন্যূনতম পক্ষে প্রতি তিন মাসে একবার এবং সর্বাধিক প্রতি মাসে একবার সেমিনার আয়োজন করা হয়। যেখানে নৈতিকতার বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সেমিনারের প্রবন্ধাবলী সঙ্কলন আকারে পরে প্রকাশিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের নৈতিক উন্নয়নের জন্য এখানে ইভিনিং কোর্সের বিষয়ে অনুমোদন থাকলেও এই পরিষেবাটি বর্তমানে বন্ধ আছে। তবে শিগগিরই এটি চালু করার এবং পেশাজীবীদের পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট লেভেলের শিক্ষার্থীদেরকেও কর্মশালায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম ইউনুস বলেন, ইভিনিং কোর্স নাম দেয়া হলেও এটা বাকি সব ইভিনিং কোর্সের মতো অর্থনৈতিকভাবে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে এটি পরিচালিত হবে না। এটি থাকবে সম্পূর্ণ ফি মুক্ত। কোনো ধরনের ফি নেয়া হবে না, পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করব এই কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের সার্টিফিকেট দিয়ে সম্মানিত করতে। আমি খুব অল্পদিন হয়েছে কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এর আগেও অনেক ভালো কাজ হয়েছে। আমি চেষ্টা করবো আরো ভালো কাজ উপহার দিতে। আমি মূলত কর্মশালা কেন্দ্রিক কাজে বেশি গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোরাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার শুধু একটিই আছে। তাই এই সেন্টার আজীবন মানুষের উপকারে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
তিনি বলেন, আমাদের বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকবে ব্যবাসায়ীদের জন্য ব্যবসায়িক নীতিবিদ্যা, সাংবাদিকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও সাংবাদিকতা, প্রশসকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও লোক প্রশাসন, চিকিৎসকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞান, পরিবেশবিদদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও নীতিবিদ্যা, শিক্ষকদের জন্য শিক্ষকতা ও নীতিবিদ্যা, রাজনৈতিকদের জন্য রাজনীতি ও নীতিবিদ্যা এবং বিচারকদের জন্য বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নীতিবিদ্যা। এসব কোর্সে পাঠদান করা হবে কেবল বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিদেরকে, যেন এর মধ্য দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে নৈতিক মূল্যবোধ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভালো সমাজ গড়ে উঠতে পারে। আমাদের কার্যক্রম এমনভাবে করা হবে যেন এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভবান হচ্ছেন এমন অভিযোগ তোলার সুযোগ কোনো অবস্থাতেই কেউ না পান।