কোনো কাজেই আসছে না ৪১৩ কোটি টাকার গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্প
- শফিউল আযম বেড়া (পাবনা)
- ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৭
- পাঁচটি মাছের অভয়াশ্রম শুকিয়ে গেছে, সেচসুবিধা বঞ্চিত কৃষক
- ৫০০ কোটি টাকার মাছ ও কৃষিপণ্য উৎপাদন পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে
মাত্র সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন না করেই ২০১৯ সালে 'গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্পের' কাজ শেষ করা হয়েছে। ফলে ৪১৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি কৃষক ও মৎস্যজীবীদের কোনো কাজেই আসছে না। এতে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিজপণ্য ও দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদন পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। এই প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করেছে পানি উন্নয়ন বিভাগ, বন বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, এলজিইডি ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
সরকার গাজনার বিল সংযোগ বাদাই নদী খনন, সেচ সুবিধা উন্নয়ন ও মৎস্য চাষ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, বন বিভাগ, মৎস্য বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০১০-১১ অর্থবছরে শুরু হয়ে চার দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে কাজ শেষ হয়। এ সময়ে প্রকল্পব্যয় বাড়ে ৭০ কোটি টাকা। কিন্তু সংযোগ খাল খনন না করায় বাদাই ও আত্রাই নদীতে পানি সরবরাহের করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিপণ্য ও দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদন পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়া পওর বিভাগের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী পরিচালিত রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান লিমিটেড প্রকল্পের ৬৮ মিটার দৈর্ঘ্য, ৯৮ মিটার প্রশস্ত এবং ১৫ মিটার উচ্চতার তালিমনগর ডুয়েল সিস্টেম পাম্পিং স্টেশন, হাইওয়ে ব্রিজ ও সার্ভিস ব্রিজ নির্মাণ করেছে। পাম্পিং স্টেশনে ৮টি সাবমারসিবল মোটর বসানো হয়েছে। প্রতিটি মোটরের ক্যাপাসিটি ৪৫০ কিলোওয়াট, ৬০৩ এইচপি। প্রতিটি পাম্প মেশিনের পানি প্রবাহ (উত্তোলন ও নিষ্কাশন) ক্ষমতা ৫.০০ কিউসেক ৮টি মেশিনের মোট ক্ষমতা ৪০ কিউসেক। ডুয়েল সিস্টেম এই পাম্পিং স্টেশনে সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধা রয়েছে। এ কাজে ব্যয় হয়েছে ২২৬ কোটি টাকা। তালিমনগরে একটি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন এবং বেড়ার কৈটোলা থেকে সুজানগরের তালিমনগর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনও চালু করা হয়েছে।
পাম্পিং স্টেশন পরিচালনার সুবিধার্থে একটি কন্ট্রোল রুম, আউটার বাউন্ডারি ওয়াল ও সিসি ক্লক পিসিং, পাম্পিং স্টেশনের উভয় পাশের গভীর খাল ভরাট, পুরাতন বাদাই নদীতে ৭০০ মিটার প্রধার খাল খনন করা হয়েছে। কিন্তু বাদাই নদীর সাথে যমুনা নদীর সাড়ে সাত কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন ছাড়াই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এতে প্রকল্পের সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় কৃষকরা। তালিমনগর প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় ৪৯ কিলোমিটার বাদাই ও আত্রাই নদী খনন করা হয়েছিল, তা ভরাট হয়ে গেছে। শাখা খাল খনন অসমাপ্ত রয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এর কমান্ড এরিয়ার এক ফসলি জমি দুই ফসলি এবং দুই ফসলি জমি তিন ফসলিতে রূপান্তরিত হবে। ফসলের গড় উৎপাদন ১৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০০ শতাংশতে উন্নীত হবে। এতে করে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিজ পণ্য উৎপাদন হবে। গাজনার বিল, বিল গ্যারগ্য, গাঙভাঙ্গার বিল ও মোস্তার বিলের অভয়াশ্রম এবং বাদাই ও আত্রাই নদী থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। শুষ্ক মওসুমে সড়ক পথে গাড়িতে কৃষকের ফসল ঘরে নেয়ার জন্য ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সাবমার্জএবল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৯ কিলোমিটার বাদাই ও আত্রাই নদী খনন করা হয়। গত ১২ বছরে বাদাই ও আত্রাই নদীর প্রায় শতভাগ ভরাট হয়ে গেছে। ১১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সেকেন্ডারি ক্যানেলের মধ্যে জিয়ার জোলা, আত্রাই নদী, হিরণ নদী, নাগনাখালী ও ভাদুরঠাকুরের জোলার মাত্র ৬৮ কিলোমিটার খনন করা হয়েছিল, যা কোনো কাজে আসেনি। এ দিকে আত্রাই ও বাদাই নদী দু'টি শুকিয়ে যাওয়ায় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। নদী পাড়ের মানুষ গৃহস্থালির কাজ, মাছ চাষ ও সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চৈত্র ও বৈশাখ মাসে গাজনার বিল, বিল গ্যারগা, গাঙভাঙ্গার বিল ও মোস্তার বিলের মাছের অভয়াশ্রম শুকিয়ে যায়। বেড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী জানান, যমুনা নদীর
বেড লেভেলের শূন্য পয়েন্টে থেকে পাম্পিং স্টেশন পর্যন্ত সাড়ে ৭ কিলোমিটার ইনট্যাক চ্যানেল নানা কারণে খনন করা সম্ভব যায়নি। এতে স্থানীয় কৃষকরা প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে না। এক প্রশ্নে তিনি জানান, প্রকল্পের শুরুতেই জমি হুকুম দখলের টাকা এলএ অফিসে জমা দেয়া আছে। নানা জটিলতায় জমি হুকুম দখল করা সম্ভব না হওয়া ইনট্যাক চ্যানেল খনন করা যায়নি। এ দিকে প্রকল্পে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাবে ইনট্যাক চ্যানেল খননের জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে। অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করা হবে।