উন্নয়ন মিরাকল নয়, ক্লাসিক্যাল
বাংলাদেশের দুর্নীতি হচ্ছে নিজেকে রক্ষার জন্য- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪৯
বাংলাদেশ এখন সস্তা শ্রমের ফাঁদে আটকে গেছে। যার সাথে শিক্ষা জড়িত আছে। বিদ্যমান শিক্ষা এখন বৈষম্য সৃষ্টি করছে। আগামীতে অর্থনৈতিক এজেন্ডা হতে হবে রাজনৈতিক এজেন্ডা। দুর্নীতি এখন অতি ধনী তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। আগে আমরা দুর্নীতি নিজেদের সুবিধার জন্য করতাম। আর এখন দুর্নীতি করা হচ্ছে নিজেকে রক্ষা করার জন্য।
বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে লিখিত একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুুর রহমান।
গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ : ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানটি হয় ধানমন্ডির সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কার্যালয়ে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো রওনক জাহান। অনুষ্ঠানের শেষে বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. যাহিদ হোসেন, ইউএনডিপি’র সাবেক কর্মকর্তা ড. সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ, সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ড. সেলিম রায়হান, ড. ফখরুল আলম, মির্জ্জা হাসান, অধ্যাপক ফেরদৌস আজিম এবং প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। দেশের বাইরে থেকে জুমে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন, ড. আলী রিয়াজ, ড. সৈয়দ আখতার মাহমুদ প্রমুখ।
হোসেন জিল্লুর বলেন, বাংলাদেশের পরিবর্তনের অন্যতম চালক যার সাথে মুক্তিযুদ্ধ জড়িত, তা হলো সাধারণ ‘পারসনালিটি রেভুলেশন’(ব্যক্তিত্বে বিপ্লব)। এটি আমাদের মানুষের আকাক্সক্ষার মাইন্ডসেট। এটি আমাদের টিকে থাকার সক্ষমতা সৃষ্টি করেছে। এটি শত বিপদের মধ্যে আগাবার স্পৃহা সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেল, এ সময়ে একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ভিশন’। তিনি আরো বলেন, এখন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সাথে নিরাপত্তাহীনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এখন আমরা নিরাপত্তাহীনতা নানা রূপ দেখতে পাচ্ছি। নীতি প্রণয়নের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া এখন ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্যারাডক্স বা আপাত স্ববিরোধী বিষয় নয় এবং এই উন্নয়ন বিস্ময়করভাবে হয়নি, বরং ধ্রুপদীভাবে (ক্ল্যাসিকাল) দেশের উন্নয়ন হয়েছে। বিভিন্ন নিয়ামকের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে তা হয়েছে। দেশে সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মিলন হয়েছে। সরকার ও বাজারের মধ্যে একধরনের মিথোজীবিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাই উন্নয়নের চালিকা শক্তি। ফলে সম্পদ বা সুশাসনের অভাব দেশের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এত দিন দেশের উন্নয়নের যেসব চালিকা শক্তি ছিল, সেগুলো যে চিরকাল একইভাবে থাকবে, তা নয়। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ হতে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশ এতদিন যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, সেগুলো আর থাকবে না। বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে যেতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম আরেকটি বই করা হয়েছিল। তখন ধারণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় যাবে। তখন অর্থনীতি নিয়ে অতটা উচ্চাশা ছিল না। এখন রাজনীতি নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে; বরং অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। তিনি আরো বলেন, পরিবর্তনের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। সেটি হলো, পরিবর্তনের জন্য মূল্য দিতে হয়।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক প্রধান সৈয়দ আখতার মাহমুদ অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের শস্য উৎপাদন বেড়েছে; উন্নতি হয়েছে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার; এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে উন্নয়ন। তিনি আরো বলেন, দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার, নীতিনির্ধারণ ও গবেষণা, আলোচনা ও সংলাপের পৃথক পৃথক জগৎ গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে সমন্বয় ছিল বলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। সরকার যেসব কিছু করে দিয়েছে, তা নয়; বরং উদ্যোক্তারাও অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু এখন এই সমন্বয় বিনষ্ট হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বইটির আরেকজন লেখক সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দ্বৈত উত্তরণের প্রসঙ্গে বলেন, দেশের যে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, এই উত্তরণ তারই প্রতিফলন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে এবং ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হবে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কি না। শ্রমঘন শিল্পের ওপর ভর করে এত দিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখান থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রফতানি যেতে হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে উচ্চ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত পণ্য রফতানি এক শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যদিও ভিয়েতনামে এ হার ৪০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিষয়ে এতদিন একধরনের রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল, অর্থাৎ এটা চলতে দিতে হবে। কিন্তু তার অভিযোগ, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ কি এফডিআই নির্ভর হবে, নাকি অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন করবে, তা নিয়ে ঐকমত্য নেই। সেলিম রায়হান আরো বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশে একধরনের স্থিতিশীলতা আছে। এই চক্র ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, তা না হলে সংস্কার হবে না; সরকারের রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতাও বাড়বে না।
দেশের উন্নয়ন নিয়ে যখন কথা বলা হয়, তখন গড় সূচক নিয়ে কথা বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না বলে উল্লেখ করেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তিনি বলেন, আমাদের অবস্থা হয়েছে অনেকটা এরকম, শরীরের অর্ধেকটা রয়েছে ওভেনে, বাকি অর্ধেকটা রয়েছে ফ্রিজে- তাই আমরা বলছি, আমরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে রয়েছি। তিনি বলেন, দেশে চরম দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের সূত্রে তিনি বলেন, দেশে যেমন অসমতার হার সবচেয়ে বেশি, তেমনি ধনীদের ধন সঞ্চয়ের হারও অনেক বেশি। সে জন্য ধনী ও গরিবের সূচক পৃথকভাবে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের মানুষের শ্রম ব্যবহারের মধ্য দিয়েই উন্নয়ন হলেও যারা এই শ্রম দিয়েছেন, তাদেরই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বলে মত দেন অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল হাসান। তিনি বলেন, শিল্প খাতের শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকরা অনেক কষ্ট করে দেশের উন্নয়ন অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পশ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে; অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মজুরি বাড়েনি।
অনুষ্ঠানের প্রথম ভাগে বইটির অর্থনীতিবিষয়ক ছয়টি প্রবন্ধের লেখক আলোচনা করার পর তার পর্যালোচনা করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন আপাত স্ববিরোধী বিষয় নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া কিভাবে উন্নয়ন হলো, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয়। বরং উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে না, এখন সেটা বুঝতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান আওয়ামী লীগের প্রতি ইঙ্গিগত করে বলেন, যে দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় দুই বছর আন্দোলন করে এর সুফলে ক্ষমতায় এসেছিল, তারাই আবার এই ব্যবস্থাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।