জিম্মি জাহাজের নাবিকরা স্বাভাবিক ডিউটিতে : ঈদের পর দ্রুত উদ্ধারের আশা
জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে দরকষাকষি চূড়ান্ত হয়নি- নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
সোমালি উপকূলে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিক জিম্মি হওয়ার প্রায় এক মাস হতে চললেও নাবিকদের উদ্ধারে দস্যুদের সাথে দরকষাকষি এখনো শেষ হয়নি। দস্যুদের সাথে আলোচনায় অগ্রগতি থাকলেও এখনো আনুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়নি। ফলে ঈদের আগে আর নাবিকদের জিম্মি দশারও অবসান হয়নি। তবে ঈদের পর স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নাবিকদের দেশে ফেরানোর লক্ষ্যে জাহাজ মালিকপক্ষ কাজ করছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ ক্ষেত্রে ২০১০ সালে সোমালি দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া একই মালিক পক্ষের জাহাজ জাহান মনি ও এর ২৫ নাবিকসহ ২৬ জনকে উদ্ধারের অভিজ্ঞতার আলোকে অগ্রসর হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জিম্মি নাবিকদের মুক্তি ও জাহাজ উদ্ধারের বিষয়ে জলদস্যুদের সাথে দফায় দফায় দরকষাকষি চলছে। ঈদের আগেই একটা সম্মতিতে পৌঁছার ব্যাপারে আশাবাদী ছিল জাহাজ মালিকপক্ষ। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। মালিকপক্ষের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নানা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে সমঝোতা মোটামুটি চূড়ান্ত হলেও আনুষ্ঠানিক রূপ পায়নি। ঈদের পরই দ্রুত যাতে নাবিকরা ফিরে আসতে পারে এখন সে লক্ষ্যে কাজ চলছে বলেও সূত্র জানিয়েছে। সূত্র মতে আলোচনায় অগ্রগতির অংশ হিসেবে দস্যুরা এখন জিম্মি নাবিকদের নিজেদের কেবিনে থাকার সুযোগ দেবার পাশাপাশি স্বাভাবিক ডিউটি পালন করতে দিচ্ছে। তবে জাহাজে সুপেয় পানির সঙ্কট রয়ে গেছে।
গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশী এই জাহাজ ও এর নাবিকরা সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর হতেই আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা নানা আলোচনায় আসে। একপর্যায়ে গত ১৪ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্সের আটলান্টা অপারেশন জাহাজ ও জিম্মি উদ্ধারে সামরিক অভিযানের প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দেয়নি। জাহাজটির মালিকপক্ষও আলোচনার মাধ্যমে নাবিকদের নিরাপদে উদ্ধারের পক্ষে জোরাল অবস্থান নেয়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ ইউ নেভাল ফোর্স আটলান্টা জিম্মি জাহাজের অদূরে তাদের যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েনের স্থির চিত্র ও ভিডিও ক্লিপ এক্সবার্তায় শেয়ার করে।
এ দিকে জিম্মি জাহাজে দস্যুরা খাবারের জোগান দিলেও সুপেয় পানির জোগান দিতে পারছে না বলে জানা গেছে। সুপেয় পানির জোগান দিতে না পারায় নাবিকদের পানির ব্যবহার সীমিত করে দিয়েছে বলেও সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএমএমএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা যেহেতু নাবিকদের ওয়েলফেয়ারের বিষয়টি মনিটর করি সে জন্য বলতে পারি জাহাজ মালিক এবং দস্যুদের মধ্যে একটা ভালো বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এর সিম্পটম্প হিসেবে তিনি বলেন, এখন নাবিকরা সবাই যার যার কেবিনে অবস্থান করতে পারছেন, ডেকে ডিউটি করতে পারছেন, মেইনটেনেন্সসহ সমস্ত কাজ করতে পারছেন, যদিও মেশিনগান তাক করা অবস্থায়। কাজেই বলা যায় জাহাজের সিচুয়েশন ভালো। জিম্মি মুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা শুনছিলাম সমঝোতা চূড়ান্ত পর্যায়ে, কিন্তু বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের ছোট কবিতার মতো শেষ হইয়াও হইলনা শেষ সে ধরনের অবস্থায় আছে।
এ দিকে এমভি আব্দুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মাদার অর্গানাইজেশন কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, জিম্মি নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দস্যুদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। আমরা আশা করছি ঈদের পর খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে নাবিকদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ প্রায় ৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই করে মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে ২৩ নাবিকসহ নিজেদের জিম্মায় নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। সে সময় জাহাজটি ২৫ দিনের খাবার এবং ২০০ টন সুপেয় পানির মজুদ ছিল। জাহাজটি কয়েক দফায় স্থান পরিবর্তন করে এখন সোমালিয়ার গদভজিরান অঞ্চলের জিফল উপকূলের কাছে নোঙর করা আছে। ইতঃপূর্বে একই গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহান মনি ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিল ২৫ নাবিক ও চিফ ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীসহ। সে সময় প্রায় ১০০ দিনের দরকষাকষিতে জিম্মি নাবিক ও জাহাজটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল কবির গ্রুপ।
নেত্রকোনায় রোকনের বাড়িতে বিষাদের কালোছায়া
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিনের বাড়িতে এবারের ঈদে আনন্দ হয়ে উঠেছে বিষাদের কালোছায়া। প্রতি ঈদে রোকন বাড়িতে পরিজন সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করলেও এবার রোকনকে ছাড়া ঈদ এসেছে বিষাদময় হয়ে। বিষাদময় হয়ে উঠেছে রোকনের পরিবার। তার মা লুৎফুন্নাহার গর্ভবতী স্ত্রীসহ কারো মনে আনন্দ নেই। ঈদ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সবার ভারাক্রান্ত মনে অজানা শঙ্কায় হু হু করে উঠেছে। ঈদে নেই কোনো প্রস্তুতি, নেই কোনো আয়োজন। শুধু অপেক্ষা রোকন কবে ফিরে আসবে তাদের মাঝে।
মা লুৎফুন্নাহার বুক চাপরিয়ে আর্তনাদ করে বলেন, তোমরা কে আছো, আমার মানিককে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও। আমার জীবন নিয়ে হলেও ওই দস্যুদের কবল থেকে এনে দাও, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলেকে ভিক্ষা চাই। নইলে আমি বাঁচবো না। এই বলে তিনি মূর্ছা যান। গতকাল দুপুরে সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরুয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে জিম্মি রোকনের মা লুৎফুন্নাহার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে বলেন ‘আর কবে আমার মানিক আমার বুকে ফিরে আসবে। আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে।’
রোকন উদ্দিন চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে পড়াশোনা শেষ করে ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকৌশলী হিসেবে এক বছর ট্রেনিং করেন। পরে ১৫ জুন কর্মস্থলে যোগদান করেন। গত বছর মার্চে টাঙ্গাইলে তানিয়া আক্তার নামে এক স্কুলশিক্ষিকাকে বিয়ে করেন। তিনি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।