চরের গাভীর খামার ও কৃষিপণ্য বদলে দিচ্ছে নদীভাঙা মানুষের ভাগ্য
- শফিউল আযম বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা
- ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
পদ্মা-যমুনার বুকে জেগে ওঠা দেড় শতাধিক চরে নীরবে ঘটেছে কৃষি বিপ্লব। আর এ বিপ্লবের মূল কারিগর হচ্ছে নদীভাঙা মানুষ। এক সময় নদীই যাদের ভূমিহীন সর্বহারা করেছে সে নদীরই চর তাদের আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। নদীভাঙা ভূমিহারা মানুষরা আজ চরে ফলাচ্ছেন বিভিন্ন অর্থকরী ফসল। শুধু কি তাই? চরে ছোট ছোট অসংখ্য গো ও মহিষের খামার গড়ে উঠেছে। আর খামারের দুধ ও কৃষিপণ্য বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য।
যমুনা ও পদ্মায় জেগে ওঠা চরে নদীভাঙা শত শত মানুষ শুধু বিপুল কৃষিপণ্যই উৎপাদন করছেন না, তারা ব্যাংক ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তুলেছেন গো-খামার। খামারগুলোতে প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ লিটার খাঁটি দুধ। এই দুধ চরবাসীর চাহিদা মিটিয়ে জেলা ও উপজেলার হাট-বাজারে বিক্রি করছে। প্রায় ৮০ হাজার লিটার দুধ সরকারি ও বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে নদীভাঙা মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। গত এক যুগে গো-মহিষের খামার ও দুগ্ধ শিল্পে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। এতে চরের নদীভাঙা মানুষের জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক চালচিত্র বদলে দিয়েছে।
নদী ভাঙনে বাস্তুহারা নিঃস্ব শতশত পরিবার পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার পদ্মা-যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরে বসতি গড়ে তোলে। তাদেরই একজন আলম প্রামাণিক বেড়া উপজেলার চরনাকালিয়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। অন্যের জমিতে কামলা খেটে ও বর্গাচাষি হিসেবে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। একবেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। ১৭ বছর আগে আলম প্রামাণিকের অবস্থা ছিল এ রকম। আর আজ? আজ তার ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হয়েছে। এলাকায় তিনি এখন অন্যতম এক সচ্ছল মানুষ। এই কয়েক বছরে সব মিলিয়ে তার সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা।
বন্যা আর নদীভাঙনের সাথে যুদ্ধ করতে হয় বলে অর্থনৈতিক দুর্দশা চরবাসীদের স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু এই স্বাভাবিক দৃশ্য এখন অনেকটাই বদলে গেছে। চরের প্রায় বাড়িতে গিয়েই এখন দেখা যাবে গরু লালন-পালনের দৃশ্য। আর এই গরুই চরবাসীদের জন্য খুলে দিয়েছে সমৃদ্ধির নতুন দ্বার। একসময় কৃষিকাজ ছিল চরবাসীদের প্রধান পেশা। কিন্তু এখন অনেক চরবাসীর প্রধান পেশা গরু পালন করা। ব্যাপক লাভের মুখ দেখে চরবাসীরা যেভাবে গরু পালনে ঝুঁকছেন তাতে শিগগিরই গরু পালনই প্রতিটি চরবাসীর প্রধান পেশা হয়ে দাঁড়াবে বলে অনেকের ধারণা।
যমুনা নদীপাড়ের নাকালিয়া বাজারটি বেড়া, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার অন্তত ৪০টি চরের বাসিন্দাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। এই বাজারের ঘাটে বসে কথা হচ্ছিল চরনাগদা গ্রামের বাসিন্দা ও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ঈসমাইল মোল্লার সাথে। তার মতে ১৮-২০ বছর আগে চরে এত গরু ছিল না। ওই সময় হাতেগোনা কিছু গৃহস্থ উন্নত জাতের গাভী পালন শুরু করেন। কেউ কেউ আবার ষাঁড়বাছুর কিনে পালন করতে থাকেন। গাভীর দুধ থেকে ভালো আয় আর গরু মোটাতাজা করা থেকে ব্যাপক লাভ করতে দেখে গরু পালনে আগ্রহীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। এভাবে এখন চরের প্রায় সব বাড়িতেই গড়ে উঠেছে গরু আর মহিষের খামার। এই খামার বিপ্লবে চরের অন্তত ৯০ ভাগ মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে।
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা নিয়ে দেশের প্রধান দুগ্ধ উৎপাদনকারী ও গরু পালনকারী এলাকা গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় এ এলাকায় গরু পালনে আগ্রহীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, গরুর খামার ও গরু পালনকারীর সংখ্যা চর এলাকায় এত ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে যে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। কিন্তু এর কারণ কী? উত্তর একটাই। আর তা হলো চর এলাকায় গরু পালনের খরচ অন্য এলাকার তুলনায় অর্ধেকেরও কম। তাই লাভ অনেক বেশি।
চৌহালী উপজেলার আওলাদ হোসেন জানান, মূল এলাকায় সারা বছর গো-খাদ্য কিনে গরুগুলোকে খাওয়াতে হয়। সেখানে কাঁচা ঘাস কম পাওয়া যায় বলে খড়-ভুষির ওপর গরু পালনকারীদের বেশি নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিন্তু চরে এর ঠিক উল্টো অবস্থা। বর্ষা মৌসুমের মাস তিনেক ছাড়া বাকি প্রায় ৯ মাস চরে পাওয়া যায় প্রচুর কাঁচা ঘাস। আর এই ঘাস চরবাসীরা সংগ্রহ করেন একরকম বিনামূল্যেই। ফলে গরু পালনের বার্ষিক খরচ তুলে আনলে চরবাসীদের খরচ সমতল এলাকার পালনকারীদের তুলনায় প্রায় অর্ধেকেরও কম। এর ওপর চরবাসীরা কাঁচা ঘাস বেশি খাওয়ান বলে তাদের গাভীগুলোর দুধ দেয়ার ক্ষমতাও সমতল এলাকার গাভীর চেয়ে বেশি।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনার সব চরই এখন গরু পালনের জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। চরগুলোর দূরত্ব ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার। বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় বাড়িতেই রয়েছে গরুর খামার। চরের প্রতিটি গ্রামেই দেখা মেলে দুধ ব্যবসায়ী ও দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির। তারা প্রতিটি বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করে বিশেষ ধরনের পাত্র বোঝাই করে ঘাটে ভেড়ানো নৌকায় পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ছানা তৈরির কারখানার অনেক লোকজন এসেও দুধ নিয়ে যায়।