ইরানের কনসুলেটে ইসরাইলের হামলায় আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কা

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনসুলেটে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক জবাব দেয়ার হুমকি দিয়েছে তেহরান। এই হামলার ঘটনাটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। ওয়াশিংটনের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের বিশ্লেষক স্টিভেন কুক বলেছেন, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, আইআরজিসি ইরাক এবং সিরিয়ায় প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে পারে। এর মাধ্যমে মার্কিন বাহিনীকে আবারো বিপদে ফেলতে পারে তারা। ইরানিরা হিজবুল্লাহকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামলা বাড়ানোর নির্দেশও দিতে পারে; যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। আলজাজিরা, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও এপি। সোমবারের ওই হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর শীর্ষ একজন কমান্ডার ও তার ডেপুটিসহ অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। এক বিবৃতিতে আইআরজিসি বলেছে, সোমবারের হামলায় ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কোরের (আইআরজিসি) অভিজাত শাখা কুদস ফোর্সের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি ও তার ডেপুটি জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি রাহিমি নিহত হয়েছেন।
ইসরাইল যে ইরানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের লক্ষ্যবস্তু করছে, কনসুলেট ভবনে হামলার ঘটনায় সেটি মনে হচ্ছে। কারণ দেশটির সামরিক বাহিনী গাজা ও লেবাননের সাথে সীমান্তে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। তবে বিশ্লেষকরা এই হামলার ঘটনাটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করতে পারে কি না তা নিয়ে বিভক্ত। ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেছেন, ইসরাইল সম্ভবত এই হামলাকে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। তিনি বলেন, ‘ইসরাইলিরা নিশ্চিত যে, তারা যদি পিছিয়ে যায়, তাহলে হুমকি কমার পরিবর্তে আরো বাড়বে। এই ধরনের হামলার ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে গেলে তা প্রতিপক্ষ শক্তিকে দুর্বল করবে বলে তারা মনে করে।

ইসরাইলের সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেছেন, সোমবার দক্ষিণ ইসরাইলের একটি নৌঘাঁটিতে ড্রোন হামলা হামলা হয়েছে। ইরানের নির্দেশে চালানো এই হামলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মঙ্গলবার সকালের দিকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, সিরিয়া থেকে ইসরাইলের দিকে ছোড়া কিছু অস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগেই বিধ্বস্ত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রোজেক্টের পরিচালক আলী ভায়েজ বলেছেন, দামেস্কে ইরানি কনসুলেটে হামলার জেরে সঙ্ঘাত বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে। তবে সেটি ইসরাইলের জন্য খুব বেশি উদ্বেগের বিষয় নাও হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ায় ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও তাদের মিত্রদের লক্ষ্যবস্তু করে আসছে ইসরাইল। তবে সোমবারের হামলাটি প্রথমবারের মতো ইরানের কনসুলেট ভবনে চালানো হয়েছে। দামেস্কের মেজেহ জেলার প্রধান দূতাবাস ভবনের পাশে অবস্থিত কনসুলেটটি সোমবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টার দিকে আক্রান্ত হয়। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপের মাঝে ইস্পাতের খুঁটিতে লাগানো ইরানের একটি পতাকা এখনো ঝুলছে।

ইরানের প্রতিক্রিয়া
সিরিয়ায় নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত হোসেন আকবরী হামলায় আহত হননি। তিনি বলেছেন, তেহরানের প্রতিক্রিয়া হবে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান এই হামলাকে সব ধরনের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা ও চুক্তির লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। কনসুলেট ভবনে হামলার ঘটনায় ইসরাইল জড়িত বলে দাবি করেছেন তিনি। পৃথক এক বিবৃতিতে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, ইরানের প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার রয়েছে। আর এই প্রতিক্রিয়ার ধরন ও হামলার শাস্তি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তেহরান। জাতিসংঘে ইরানের মিশন বলেছে, এই হামলার ঘটনাটি জাতিসংঘের সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং কূটনৈতিক ও কনসুলার চত্বর রক্ষার মূলনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন।
অন্য দিকে হামলার নিন্দা জানাতে জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইরানি মিশন সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এই হামলা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য উল্লেখযোগ্য হুমকি বলে সতর্ক করে দিয়ে ইরানি মিশন বলেছে, হামলার চূড়ান্ত জবাব দেয়ার অধিকার রয়েছে তেহরানের। সিরিয়ায় কনসুলেট ভবনে ইসরাইলি হামলার ঘটনার পরপরই তেহরানের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার মানুষ। তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

অন্যদের প্রতিক্রিয়া
ইরানের অন্যতম মিত্র সিরিয়া বলেছে, ইসরাইলি হামলায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। হামলার পরপরই ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মেকদাদ। তিনি বলেছেন, আমরা দামেস্কে ইরানের কনসুলেট ভবন লক্ষ করে চালানো এই নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের মিত্র রাশিয়াও ইরানি কনসুলেটে হামলার নিন্দা জানিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা সিরিয়ায় ইরানের কনসুলার মিশনের বিরুদ্ধে এই অগ্রহণযোগ্য হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। লেবাননের ইরান-সমর্থিত শক্তিশালী সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, দামেস্কে হামলার ঘটনায় ইসরাইলকে চড়া মূল্য দিতে হবে। গত ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হামাসের সমর্থনে ইসরাইলে প্রায় প্রতিদিনই হামলা চালিয়ে আসছে হিজবুল্লাহ।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ বলেছে, এই অপরাধের জন্য শত্রুপক্ষকে শাস্তি পেতে হবে। অবশ্যই হামলার প্রতিশোধ নেয়া হবে। ইরাক, জর্ডান, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্যান্য মুসলিম দেশও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিকদের বলেছেন, ওয়াশিংটন ওই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সঙ্ঘাত বৃদ্ধির কারণ হতে পারে এমন যেকোনো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছে।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বিদেশী গণমাধ্যমের খবরের বিষয়ে মন্তব্য করি না। তবে মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত চারজন ইসরাইলি কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছে। তারা স্বীকার করেছে, দামেস্কে ইরানি কনসুলেটে হামলার ঘটনায় ইসরাইল জড়িত।