১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বেলকুচিতে জনতা ব্যাংকের পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ

ম্যানেজার আমিন গ্রাহকের টাকায় গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান

টাকার হিসাব নিতে ব্যাংকে গ্রাহকদের ভিড়
-


চাকরির আড়ালে গ্রাহকদের টাকা অবৈধভাবে তুলে নিয়ে নিজের ব্যবসায় গড়ে তুলেছেন জনতা ব্যাংক তামাই শাখার সেই ম্যানেজার আল-আমিন। ঠিকাদারিসহ পার্টনারশিপে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কারখানা ও দোকানপাট। সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ রকম তথ্য। এ দিকে জনতা ব্যাংক প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো পাঁচ সদস্যের একটি তদন্তদল গতকাল বুধবার সকাল থেকে তদন্ত শুরু করেছে। এর আগে গত সোমবার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই সদস্যের তদন্তদলও তাদের মতো করে তদন্ত করছে। ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাতের খবর পেয়ে ওই ব্যাংকের একাউন্টধারী গ্রাহকরা উৎকণ্ঠিত হয়ে হিসাব মেলাতে ভিড় করছেন। গ্রাহকদের সিসি অ্যাকাউন্টসহ বিভিন্ন হিসাব থেকে নয়ছয় করা বড় অঙ্কের টাকার পরিমাণ বের হওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে এখনই এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক কথা বলতে চাচ্ছে না তদন্তকারীদল।

জনতা ব্যাংক এরিয়া কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নজরুল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতে জনতা ব্যাংক তামাই শাখা থেকে পাঁচ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের দায়ে গত রোববার রাতে গ্রেফতার হন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ তিন কর্মকর্তা। এর আগে অভিযুক্তরা আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করে ২০ লাখ টাকা ভোল্টে ফেরত দেয়ার কথা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সকাল থেকে অনুসন্ধানে গিয়ে ব্যবস্থাপক আল-আমিনের পার্টনারশিপে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়। আল-আমিনের বসবাস সিরাজগঞ্জ শহরের ধানবান্ধি মতি সাহেবের ঘাট মহল্লায়। সেখানকার স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ছয় মাস যাবৎ ব্যবস্থাপক আল-আমিনের বসতবাড়ির পাশের আবুল পাটোয়ারীর পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে গড়ে তুলেছেন ইলেক্ট্রিক তার উৎপাদনের কারখানা। ‘এম আর ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের কারখানায় পিভিসি ইনস্যুলেটেড ক্যাবল উৎপাদন করে তা বাজারজাত করার জন্য সিরাজগঞ্জ শহরের বড় বাজার পাতিলাপট্টিতে পুরাতন হিরাঝিল মার্কেটে নতুন ভবনে ঝকঝকে ‘আবরার এন্টাপ্রাইজ’ নামে ইলেকট্রনিক দোকানের প্রোপ্রাইটার হিসেবে ব্যবসায় করছেন আল-আমিনের আপন ভাতিজা মঈন উদ্দিন পলাশ। ‘আবরার এন্টাপ্রাইজ’-এর আবরার নামটি আল-আমিনের ছোট ছেলের। ঢাকার নবাবপুরে এবং মিরপুরে এম আর এন্টারপ্রাইজ নামে আলাদা ইলেট্রিক্যাল সামগ্রীর দোকান আছে।

গাইবান্ধায় যমুনা নদী তীর রক্ষাবাঁধের কাজে সিসি ব্লক তৈরি প্রকল্পে আল-আমিন টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের হোসেনপুর মোল্লাবাড়ি মহল্লার মিজানুর রহমানের সাথে পার্টনারশিপে এসব ব্যবসায় কারখানা ও দোকানপাট পরিচালনা করেন ব্যাংক ম্যানেজার আল-আমিন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তাদের ব্যবসায়িক অফিস রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ শহরের ‘আবরার এন্টাপ্রাইজ’ নামে ইলেকট্রনিক দোকানের প্রোপ্রাইটার হিসেবে ব্যবসায় পরিচালনাকারী আল-আমিনের ভাতিজা মঈন উদ্দিন পলাশকে জিজ্ঞাসা করলে আবরার এন্টাপ্রাইজের মালিকানা নিজের বলে দাবি করে বলেন, ইলেকট্রিক তার উৎপাদন কারখানা মিজানুর রহমানের। অপর দিকে আল-আমিনের বন্ধু মিজান বলেন, আল-আমিন না ‘আবরার এন্টাপ্রাইজের মালিক আমি’। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানিয়েছেন- এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক যৌথভাবে ব্যবস্থাপক আল-আমিন ও মিজান।

গতকাল বুধবার দুপুরে আল-আমিনের ধানবান্ধি মহল্লার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার স্ত্রী রুনা খাতুনের সাথে। তিনি বলেন, মিজানের সাথে স্বামী আল-আমিনের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব আছে। কিন্তু তার সাথে কোনো প্রকার অংশীদারিত্বমূলক ব্যবসার কথা তিনি জানেন না। তবে স্বামী আল-আমিন কারো খপ্পরে পড়ে এ রকম পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
গতকাল বুধবার সকালে বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামে গিয়ে ব্যাংকের বিভিন্ন গ্রাহকের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তামাই গ্রামের তাঁত ব্যবসায়ী শামীম সেখের ছেলে সাদি সেখ বলেন, এই ব্যাংকে ‘শামীম ব্রাদার্স’এবং ‘সাদি এগ্রো ফার্ম’ নামে আমাদের দু’টি অ্যাকাউন্ট আছে। এর মধ্যে শামীম ব্রাদার্স হিসাবের ২৩ লাখ আর সাদি এগ্রো থেকে ৩২ লাখ টাকা ডেমি চেকে স্বাক্ষর জাল করে উত্তোলন করা হয়েছে।
মুসলিম উইভিং ফ্যাক্টরি নামীয় হিসাবের মোতালেব জোয়ার্দার বলেন, আমার হিসাবে ৪৮ লাখ টাকার সিসি লোন পাস করা আছে। আমি ২০২২ সালের পরে টাকা উত্তোলন করিনি। ব্যাংকের এই অবস্থা জেনে হিসাবের প্রতিবেদন তুলে দেখা যায় যে, ৪৮ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এ রকম অভিযোগ অনেক গ্রাহকের। শাহিন কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজের সিসি হিসাব থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। তাঁত ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলামের ১৫ লাখ টাকা, চান টেক্সটাইলের চান মিয়া আকন্দের ১০ লাখ টাকা, হাজী আব্দুল্লাহ আকন্দের পাঁচ লাখসহ অনেক গ্রাহকের প্রায় কয়েক কোটি টাকা তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও বেশ কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে নগদ হাওলাতি টাকা নিয়েছেন ব্যবস্থাপক আল-আমিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক বলেছেন, গত ২৪ মার্চ বিপদের কথা বলে স্বল্প সময়ে পরিশোধের আশ্বাসে ২০ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলেন, দুই লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা দিতে অস্বীকার করাতে ব্যবস্থপক আল-আমিন গ্রাহককে না জানিয়ে ১০ লাখ টাকা তুলে নেন এবং একই দিন সন্ধ্যায় ব্যবস্থাপকের নিজ নামে ওই অ্যাকাউন্ডধারীর কাছ থেকে পিয়ন শহিদুল মারফত ১০ লাখ টাকার চেক লিখিয়ে নিয়েছেন।
মোহাম্মাদ আলী উইভিং ফ্যাক্টরির মালিক হাজী আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা ব্যাংককে বিশ্বাস করে টাকা রাখি সেই ব্যাংক যদি এ রকম কাজ করে তাহলে আমরা যাবো কোথায়?
বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শামছুল হক জানান, এই ব্যবস্থাপক বিভিন্ন সময় লুস চেক ব্যবহার করে সিসি অ্যাকাউন্টের টাকা তুলে নিয়েছে। যাতে স্বাক্ষরের মিল নেই, চেকের সিরিয়ালের পরম্পরা নেই। ব্যাংকের ক্যাজুয়াল পিয়ন শহিদুল বলেন, ম্যানেজার স্যার বিভিন্ন সময়ে আমার নাম ব্যবহার করে আমার মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়েছেন। তবে টাকা উত্তোলনে আমার নাম লিখে দিয়ে থাকতে পারেন; কিন্তু আমি জানি না।
জনতা ব্যাংক এরিয়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জনতা ব্যাংক তামাই শাখার ভোল্টের লিমিট ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু আত্মসাৎকৃত পাঁচ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভোল্টে থাকার সঠিক উত্তর দিতে পারেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

জনতা ব্যাংক সিরাজগঞ্জ এরিয়া অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, তদন্ত চলছে, তদন্তে সঠিক বিষয়টি বের হয়ে আসবে। তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করাই ভালো। তদন্ত শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
গত রোববার দিবাগত রাতে জনতা ব্যাংক সিরাজগঞ্জ এরিয়া কার্যালয়ের ডিজিএম নজরুল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের দায়ে জনতা ব্যাংক তামাই শাখার ব্যবস্থাপক আল-আমিন, সহকারী ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম, ব্যাংকের কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সোমবার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরে অভিযোগটি বিধি মোতাবেক সাধারণ ডায়েরি আকারে গ্রহণ করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন অফিস পাবনাতে পাঠানো হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত পাবনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক খায়রুল হক বলেন, অভিযোগটি অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্য কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল