সিজারে জন্ম বেড়েছে ৯.৩ শতাংশ
ক্লিনিক মালিক ও ডাক্তারদের লোভের ফল- হামিম উল কবির
- ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০৫
দেশে গত এক বছরে সিজারে (অস্ত্রোপচার) জন্ম বেড়েছে ৯.৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সিজারে (অস্ত্রোপচার) জন্ম নিয়েছে ৫০.৭ শতাংশ শিশু, ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালে সিজারে জন্ম হয়েছে ৪০.৪ শতাংশ শিশুর।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বাধ্য না হলে সিজারে সন্তান প্রসব করা ঠিক নয়। সিজারে জন্ম হলে তা যেমন মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি শিশু স্বাস্থ্যেরও কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং সিজারে জন্ম নেয়া শিশুদের বড় না হওয়া পর্যন্ত নানা ধরনের রোগ-শোক লেগেই থাকে। তারা বলছেন, এক বছরে সিজার বেবির সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে যাওয়াটা খুবই অ্যালার্মিং। এটা হচ্ছে সরকারি সংস্থার উদাসীনতায় এক শ্রেণীর ক্লিনিক মালিক ও গাইনির ডাক্তারদের অর্থলোভের কারণে। যতদিন পর্যন্ত অনৈতিক লোভের শেষ না হবে ততদিন এটা চলতেই থাকবে এবং জাতির সর্বনাশ ঘটবে।
বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে শিশুর স্বাভাবিক জন্মহার ছিল ৪৯.৩ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৫৮.৬ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে স্বাভাবিকভাবে শিশু জন্মহারও কমেছে একই হারে অর্থাৎ ৯.৩ শতাংশ। সিজার বেবির জন্ম এখনো শহরের চেয়ে গ্রামে কম। শহরে সিজার বেবির জন্মহার ৫৯.১ শতাংশ, অন্যদিকে পল্লী এলাকায় ৪৮.৪ শতাংশ। এক বছর আগেও ২০২২ সালে পল্লী এলাকায় সিজার বেবির জন্মহার ছিল ৩৮.৫ শতাংশ।
প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি শিশু প্রসব হয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সন্তান জন্মদানের হার ৩৯.৭৬ শতাংশ। আর সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে জন্মদানের হার ২৬.৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০২২-এ বলা হয়েছে, তখন দেশে সিজারের জন্মহার ছিল ৪৫ শতাংশ এবং এই সিজার বেবিদের ৮৪ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। বিডিএইচএস ৩০ হাজার ৩৫৮ বাড়ির ৩০ হাজার ৭৮ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে উল্লিখিত তথ্য দিয়েছিল। বিডিএইচএসের জরিপ অনুযায়ী ২০১৭ সালে সিজার বেবির জন্মহার ছিল ৩৪ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৪৫ শতাংশ, যা বিবিএসের তথ্যের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা: এম মোজাহেরুল হক বলছেন, ক্লিনিক মালিক ও গাইনি চিকিৎসকের সীমাহীন লোভের কারণে এই অপকর্মটি হচ্ছে। তাছাড়া সিজারিয়ান সেকশনে বেবি জন্ম দেয়া একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু পরিবার সমাজে নিজের স্ট্যাটাস বাড়াতে সিজারিয়ান সেকশনে শিশুর জন্ম দিতে গাইনি চিকিৎসকদের পীড়াপীড়ি করে থাকেন। সিজারিয়ানে জন্মদানে নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয় মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য। সিজারে অপ্রয়োজনীয় জন্ম হলে সংক্রমণ ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, অঙ্গহানি, পেটে রক্ত জমাট বেঁধে থাকার কারণে মায়েদের সুস্থ হতে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। এছাড়া সিজারিয়ানের কারণে স্বাভাবিক জন্মের লাভজনক দিকগুলোও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শিশু মায়ের প্রসবের পথ দিয়ে যদি স্বাভাবিকভাবে বের হয় তাহলে তার শরীর কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া গ্রহণ করতে পারে। এসব উপকারী ব্যাকটেরিয়া শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।
সিজারের জন্মের কারণে শিশু প্রসবের পথ দিয়ে বের হয় না বলে ওই উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো পায় না। এছাড়া মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য মায়ের সাথে শিশুর যে শারীরিক নৈকট্যে আসা দরকার সিজারিয়ান হলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তা দেরিতে ঘটে। কারণ মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য শিশুকে তখন কিছু সময় দূরে রাখা হয়। শিশু জন্মের পর পরই মায়ের শাল দুধের বাড়তি উপকারিতা রয়েছে। সিজার হলে শিশু তা থেকে বঞ্চিত হয়।
শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে সেভ দ্য চিলড্রেন। এই সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে বেশি। সংস্থাটি বলছে, বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলোতে যত শিশু জন্ম নেয় তার ৮০ শতাংশই হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সংস্থাটি বলছে, ২০১৮ সালে যত সিজারিয়ান হয়েছে তার ৭৭ শতাংশই চিকিৎসাগতভাবে অপ্রয়োজনীয় ছিল। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রসবকালীন অস্ত্রোপচার ৪ থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বাংলাদেশে কেন এত বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে ছুরি-কাঁচির মাধ্যমে এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ডা: এম মোজাহেরুল হক বলেন, এখানে প্রশিক্ষিত ধাত্রীর অভাব রয়েছে। ধাত্রীদের শেখানোই হয়, ‘কিভাবে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে শিশুর জন্মদানে মাকে সহায়তা করা যায়, তাদের সিজার বিদ্যা শেখানো হয় না। ফলে প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যা বাড়ালে সিজার বেবির সংখ্যা কমে যাবে। জন্মদানে জটিলতা সৃষ্টি হলে, সময় বেশি নিলে তখন ধাত্রীরা গাইনির ডাক্তারের কাছে মাকে রেফার করেন। বাংলাদেশে এক সময় বাড়িতেই শিশুর জন্ম হতো তবে অপ্রশিক্ষিত ধাত্রীর হাতে। তাতে কিছু সমস্যা হতো কিন্তু তখন প্রায় সব শিশুর জন্মই হতো ধাত্রীদের হাতে। বর্তমানে বাংলাদেশে ধাত্রী বা মিডওয়াইফ কলেজ থেকে বছরে কিছু ধাত্রী বা মিডওয়াই বের হচ্ছে তবে সংখ্যায় একেবারেই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার ধাত্রীর প্রয়োজন। আছে মাত্র তিন হাজারের মতো।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা