০৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫
`

বেসরকারি বিনিয়োগে ঋণাত্মক প্রবাহ : নেপথ্যে ৪ কারণ

-


দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘ দিন ধরে টাকার সঙ্কট চলছে। এ সঙ্কট মেটাতে প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছু ব্যাংক ধার করে চলছে। এর ওপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব তো রয়েছেই। চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা আস্থাহীনতা রয়েছে। মূলত এ চার কারণেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ কমে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যেখানে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ছিল প্রায় ২ শতাংশ বেশি, সেখানে সাত মাসের হিসেবে তার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, যেভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমে যাচ্ছে তা অব্যহত থাকলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। কমে যাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘ দিন ধরে টাকার সঙ্কট চলছে। আর এ সঙ্কটের মূল কারণ হলো যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন তাদের একটি অংশ ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এতে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। আর দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে অদৃশ্য খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে, যেসব ব্যাংকের কাছে আগে বড় অঙ্কের অলস টাকা পড়ে থাকত তারা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করেছে ১৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এর আগের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল ২০ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। আর এ কারণে এক শ্রেণীর ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ না দিয়ে সরকারের ট্রেজারি বিল বন্ডেই বিনিয়োগ করতে বেশি দেখাচ্ছেন। কারণ, এক দিকে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ঋণ দিলে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এ কারণেই সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করলে এক দিকে নিশ্চিত বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে, অপর দিকে খেলাপি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। খেলাপি ঋণ বিশেষ করে মন্দ মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এতে কমে যায় ব্যাংকের আয়। দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো। সবমিলেই এখন এক শ্রেণীর ব্যাংক সরকারের ঋণ দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। এর প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে।

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার আরো একটি কারণ হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি। সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। আর নীতি সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিনিয়োগের সুদ বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলো যখন টাকার সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বেশি সুদে ধার নিতে হচ্ছে। আর এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেছে। তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা ব্যয় বেড়ে গেছে। একই সাথে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে গেছে। সবমিলেই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক বিনিয়োগে প্রকল্প হাতে নিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।
অপর দিকে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব তো রয়েছেই। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ ব্যয় কমে যাওয়া সবমিলেই বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছিল ৭৬ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭৪ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকার। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছিল প্রায় দুই শতাংশ। কিন্তু জুলাই-জানুয়ারি সাত মাসের হিসেবে তা ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেভাবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমছে তাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হবে না। এতে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, যা দেশের জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।


আরো সংবাদ



premium cement