০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জিলহজ ১৪৪৫
`

বহুমাত্রিক দূষণে বাড়ছে ক্যান্সারের ঝুঁকি

-


জলবায়ু পরিবর্তনে কমছে জীববৈচিত্র্য। শিল্পে রাসায়নিকের ব্যবহারে বহুমাত্রিক দূষণ বাড়ছে। দূষিত বাতাস, পানি ও মাটি থেকে উৎপাদিত খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে বিষ। এতে করে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এ ছাড়া বর্তমান কৃষিব্যবস্থায় সবকিছু একসাথে রোপণ পরিবেশগত মৃত্যু ডেকে আনছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের দেহে ক্যান্সারসহ মারাত্মক ব্যাধির প্রধান কারণ বিষাক্ত খাদ্য। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে জীববৈচিত্র্য কমার সাথে দিন দিন শিল্পে রাসায়নিকের বাড়তি ব্যবহার, শিল্পকারখানা, খনি, কৃষিকাজের দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাটিকে বিষিয়ে তুলছে। দূষণের কারণে খাদ্য ও পানি অনিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি মাটি ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে। পরিস্থিতি এখনি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়ে তা ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখতে পেয়েছে, অপরিশোধিত পোলট্রি বর্জ্য সরাসরি জমিতে ও জলাধারে ব্যবহারের কারণে শাকসবজিতে ঢুকে পড়ছে রোগজীবাণু। অন্য দিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্যমতে, সারা দেশের মাটিতেই প্রয়োজনের তুলনায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, দস্তা ও বোরন এবং অঞ্চলভেদে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতি রয়েছে।
সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে দেশে পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের পুকুর ও জলাশয়ের পানিতে বিষাক্ত কীটনাশক ডাইএল্ড্রিনের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। অন্য দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী দেশে ভোগ্যপণ্যের প্রায় ৪৮ শতাংশই ভেজাল। ১০ বছর আগেও এ দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০ লাখ, বর্তমানে সেটি দুই কোটিরও বেশি, যার অর্ধেকই শিশু। আর দেশে প্রতি বছর ৮৪ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

খাদ্যে দূষণের বহুমাত্রিক তথ্য তুলে ধরে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, শুধু চাষাবাদের মাধ্যমেই নয়, অন্যভাবে খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়েও তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের দূষণ। প্রতিদিন দেশে কমছে কৃষিজমি এবং প্রাকৃতিক পানির উৎসস্থল। বেশি খাদ্য ফলানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এতে মাটি দূষণের সাথে দূষিত হচ্ছে সামগ্রিক পরিবেশ। জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে যাচ্ছে। তাতে করে দূষণ ছড়াচ্ছে পানিতে। এভাবে করে মাটি-পানি থেকে উৎপাদিত খাদ্য মানুষের শরীরে গিয়ে তাদের অজান্তেই মারাত্মক সব রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে। সে সাথে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
জাতিসঙ্ঘ তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, অনেক দেশই মাটিদূষণ নিয়ে সচেতন নয়। অথচ শিল্পদূষণ, খনি, কৃষিকাজ ও দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাটিকে বিষিয়ে তলছে। দূষণকারী পদার্থের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের ধাতু, সায়ানাইড, ডিডিটি ও নানা ধরনের কীটনাশক এবং পিসিবির মতো দীর্ঘস্থায়ী জৈব রাসায়নিক পদার্থ। দূষণের কারণে খাদ্য ও পানি অনিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে মাটির ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
নেদারল্যান্ডসের ওয়াজেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, জীববৈচিত্র্যের জন্য ফসলের ভিন্নতা খুবই কার্যকর। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে জীববৈচিত্র্য যেমন কমছে তেমনি বর্তমান কৃষিব্যবস্থায় সবকিছু একসাথে রোপণ একধরনের পরিবেশগত মৃত্যু ডেকে আনছে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের (মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ) অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, অব্যাহত দূষণে মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। এই মাটি-পানি থেকে যা উৎপাদন হয় তা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে গিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ফলে মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্যান্সারঝুঁকিতে পড়ছে। তিনি বলেন, এটা এখনি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে একসময় তাতে একসাথে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটবে।
অপর দিকে পরিবেশবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীর মধ্যে ১০ থেকে ২০ নম্বরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান। এতে করে পরিবেশদূষণ, শব্দদূষণ, পয়ঃনিষ্কাশন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকা একটা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে পড়েছে। এতে করে ঢাকা ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার মতে, এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষায় দূষণ বন্ধ করতে হবে। শিল্পস্থাপনা, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল, গার্মেন্ট ও গুরুত্বপূর্ণ অফিস স্থাপনাকে পরিকল্পিতভাবে ঢাকার বাইরে ডিভিশন হেডকোয়ার্টার বা উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে এমন এলাকায় স্থানান্তর করতে হবে। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, সবুজায়ন বৃদ্ধি, নদীখনন, জলাশয়-নদীনালা দখলমুক্ত করে তা রক্ষায় পদেক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাতে নাগরিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement