০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জিলহজ ১৪৪৫
`

পুড়ে ছাই মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট

কৃষি মার্কেটে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী : নয়া দিগন্ত -


- পুড়েছে ৪০০ দোকান
-ক্ষয়ক্ষতি ২৫০ কোটি টাকা

ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট। এ ঘটনায় ছোট-বড় মিলে অন্তত ৪০০টি দোকান পুড়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ৩টার পর এই আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট কাজ করে। তাদের সাথে যোগ দেয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বিশেষ দল। ততক্ষণে আগুনে পুড়ে ছাই হয় ব্যবসায়ীদের সহায় সম্বল। পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পুড়ে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট। প্রাথমিকভাবে শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রাজধানীর অন্যতম বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে ছাই হয় প্রায় পাঁচ হাজার দোকান। এর রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর অন্যতম আরেকটি মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ঘটল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।
জানা গেছে, মার্কেটটিতে পাঁচশ’র বেশি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে কাজ করে দুই হাজারের বেশি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। মার্কেটে সবজি দোকানের পাশাপাশি জুতার দোকান, স্বর্ণের দোকানসহ অনেক ধরনের দোকান রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোতে কোটি কোটি টাকার মালামাল ছিল। আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, মার্কেটের ডান পাশের অংশ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। মিনিটের মধ্যে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট পৌঁছে আগুন নেভাতে শুরু করে। কিন্তু আগুন ছড়িয়ে পড়ায় আরো ৬টি ইউনিট এসে যোগ দেয়। আগুন লাগার পর থেকে ঘটনাস্থলে ভিড় করেন উৎসুক জনতা। উৎসুক জনতার কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাজ করতে অসুবিধায় পড়তে হয়। এ ছাড়া আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পানি সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্মকর্তা রাশেদ বিন খালেদ জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ৪৩ মিনিটে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন লাগার খবর পান তারা। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে তাদের সাথে যোগ দেয় আরো ৬টি ইউনিট। আইএসপিআর জানিয়েছে, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর বিশেষ দল।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের একটি মুদিদোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা মশার কয়েল থেকে এই আগুন লাগতে পারে। তবে কিভাবে আগুন লেগেছে, তা তদন্ত শেষে বলা যাবে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী। গতকাল সকাল পৌনে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন। বুধবার রাত সাড়ে ৩টার পর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট কাজ করে। তাদের সাথে যোগ দেয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বিশেষ দল। পরে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৩টা ৪৩ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস আগুন লাগার খবর পায়। ৩টা ৫২ মিনিটে মোহাম্মদপুর থেকে প্রথমে একটি ইউনিট আগুন নেভাতে অংশ নেয়। আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে একে একে ১৭টি ইউনিট এ কাজে যুক্ত হয়। পানি ছিটিয়ে সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে মার্কেটের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। ফায়ার সার্ভিস এখন ভেতরের ক্ষতিগ্রস্ত মালামাল সরানোর কাজ করছে। তিনি বলেন, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৫০ কর্মী অংশ নিয়েছেন। তাদের সহযোগিতা করেছে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং ঢাকা ওয়াসা।
মার্কেটের একটি মুদি দোকান থেকে এই আগুনের সূত্রপাত উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক বলেন, কিভাবে আগুন লেগেছে, তা তদন্ত শেষে বলা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা মশার কয়েল থেকে এই আগুন লাগতে পারে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি, তবে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মী সামান্য আহত হয়েছেন। মার্কেটের সামনে অনেক ভাসমান দোকান ও উৎসুক জনতার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে। মার্কেটটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আগুনে ২১৭ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত : ডিএনসিসি
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ২১৭টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে মার্কেটটি পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা। সেলিম রেজা বলেন, মার্কেটে আমাদের বরাদ্দ দেয়া দোকান ছিল ৩১৭টি। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ২১৭টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মার্কেট-সংলগ্ন ফুটপাথে অনেক অবৈধ দোকান ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সেলিম রেজা বলেন, আমরা মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করছি। সিটি করপোরেশন তাদের (ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী) পাশে দাঁড়াবে। যতটুকু সম্ভব ডিএনসিসির পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে।
পরে ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে সরকারের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তার চেষ্টা করা হবে।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে বলা হয়েছে, মার্কেটের ভেতরে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আগেই দোকান মালিক সমিতি-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। সেলিম রেজা বলেন, এখানে সমিতি আছে। তাদের আমরা এই কাজগুলো (অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা) করার জন্য বারবার নির্দেশনা দিয়েছি, অনুরোধ করেছি। কিন্তু কাজগুলো তারা না করায় এখন আমরা এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখতে পাচ্ছি।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করা হচ্ছে
মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের তালিকা করতে বুথ খুলেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার বেলা দুইটা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে।
মোহাম্মদপুর সরকারি কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ ওয়াহিদুল হক জানান, তাদের এই মার্কেটে সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত ৩১৭টি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া ১২৯টি সাব কন্ট্রাক্টভিত্তিক দোকান রয়েছে। এর বাইরে সেখানে আরো কিছু খুচরা ব্যবসায়ীর দোকান রয়েছে। বেশির ভাগই এখন আগুনে পুড়ে ছাই। কাঁচাবাজার ছাড়াও মার্কেটটিতে রয়েছে জুয়েলারি, মুদি, চাল, তৈজসপত্র, হার্ডওয়্যার, প্লাস্টিক, রূপসজ্জার পণ্য ও জুতার দোকান। শুধু মার্কেটের এক পাশে থাকা মাছ-মাংসের দোকানগুলোয় আগুন পৌঁছাতে পারেনি।
সকাল থেকে ব্যবসায়ীরা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাথে আগুন নেভানোর কাজে তৎপর ছিলেন। আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে তারা দোকানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে বেশির ভাগ দোকানে ছাইভস্ম ছাড়া উদ্ধার করার মতো কিছুই তারা পাননি।
ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপর তার নির্দেশে সেখানে অস্থায়ীভাবে একটি বুথ বসানো হয় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করার জন্য। দোকানের তালিকা করার ক্ষেত্রে মূল মালিকের নামে সিটি করপোরেশনের বরাদ্দপত্র, দোকান ভাড়া দেয়া থাকলে তার প্রমাণপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও ট্রেড লাইসেন্স দেখে নিচ্ছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া দোকান কর্মচারীদেরও তালিকা করছে জেলা প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের পরিচয়পত্র ও বেতনের প্রমাণপত্র দেখা হচ্ছে।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো: আবদুর রহমান বলেন, আমরা তালিকা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাব। সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ কিংবা অন্য সহায়তা দেয়া হবে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement