২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

পিএইচডি করা অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে অনভিজ্ঞ মাস্টার্স পাস প্রার্থীদের নিয়োগ

-

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতিকালে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একটি ডিসিপ্লিনে পিএইচডি করা ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থীদের বিশেষ কায়দা করে বাদ দেয়া হয়েছে। সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সবেমাত্র মাস্টার্স পাস করা অনভিজ্ঞ লোকদের।
ভার্সিটির বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, খুবি গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়। তাতে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বিজিই) ডিসিপ্লিনের তিনটি প্রভাষক পদে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এ তিন পদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ২৫ জন আবেদন করেন। তাদের মধ্যে চারজন পিএইচডি করা প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে ড. আহসানুল বারী পিএইচডি করেন অস্ট্রেলিয়ায় এবং সেখানকার ডিয়াকিন ভার্সিটিতে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। ড. নাজমুল হক মালয়েশিয়ার মালয় ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করেন এবং সেখানকার এমএএইচএসএ ভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার। তার ৩২টি প্রকাশনা রয়েছে। ড. গাজী মহিউদ্দিন কোরিয়ার চাংবাক ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করেন এবং সুইডেনের স্টকহোমস্থ সেল অ্যান্ড মলিকুলার ইনস্টিটিউটে কাজ করছেন। তার ২৫টি প্রকাশনাও রয়েছে। অপর পিএইচডি ধারী প্রার্থী ড. তওহিদুর রহমান নুরুন্নবীর প্রকাশনার সংখ্যা ১৪টি। এরা খুবিরই গ্র্যাজুয়েট।
ভার্সিটি প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি অতিরিক্ত যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। তবে এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রির জন্য উপরে উল্লিখিত কোনো যোগ্যতার কোনো শর্ত কোনোভাবেই শিথিলযোগ্য হবে না। এ ছাড়া গত ২২ সেপ্টেম্বর বিজিই ডিসিপ্লিনের যে সভা অনুষ্ঠিত হয় সে সভায় লেকচারার নিয়োগের ক্ষেত্রে কট এৎধফঁধঃব, ছঁধষরভরবফ এৎধফঁধঃব, ইএঊ এৎধফঁধঃব, গঝ, চয উ, জবংবধৎপয ধঃঃধপযসবহঃ অগ্রাধিকার দিতে হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে সভায় ডিসিপ্লিন প্রধান ড. আয়েশা আশরাফসহ সিনিয়র এবং জুনিয়র শিক্ষকরা অংশ নেন। অথচ ডিসিপ্লিনের ডিন ও প্রধানকে নিয়ে গঠিত নিয়োগ বোর্ড পিএইচডি করা প্রার্থীদের বাদ দিয়ে দেয়। নিয়োগ প্রাপ্ত তিনজন মো: শামীম গাজী শুধু এম এ পাস, অন্তরা সরকার ৩.৯৯ গ্রেড পয়েন্ট নিয়ে বিএসসি ও মাস্টার্স এবং অমিত সরদারও ৩.৬০ গ্রেড পয়েন্ট নিয়ে বিএসসি ও মাস্টার্স পাস। তাদের কোনো ধরনের রিসার্চ বা টিচিং অভিজ্ঞতা নেই। খুলনা ভার্সিটির মতো একটি স্পেশালাইজড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিধারীদের বাদ দিয়ে এ রকম শুধুমাত্র মাস্টার্স পাস প্রার্থীর নিয়োগ বেশ বিস্ময়কর বটে।
এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে একজন প্রার্থী ড. আহসানুল বারীর ফেসবুক স্ট্যাটাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো অস্বচ্ছতার বিষয় বোঝাতে। তিনি লেখেন, ‘নিয়োগ বাণিজ্য, নিয়োগের নামে প্রহসন এমন অনেক ঘটনা পেপার পত্রিকায় পড়েছি, শুনেছি। আমার নিজের জীবনে যে সেই প্রহসনের মুখোমুখি হতে হবে, এটা স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রভাষক পদের জন্য আবেদন করার পর যথাসময়ে ইন্টারভিউ লেটার পেলাম। ই-মেইলের মাধ্যমে ২৫ জনকে সিসি দিয়ে ইন্টারভিউ লেটার পাঠানো হয়। পরে ডাকযোগেও পাই এবং মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে ইন্টারভিউ কনফার্মেশন পাই। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে ইস্যুকৃত ইমেইল (অ্যাটাচমেন্ট-২) এর ওপরে ‘স্মারক নং খুবি/প্রশা-৯৬/৯১-১৩৭১ (১-২৫)’ উল্লেখ ছিল। এই স্মারক নং এ ১-২৫ বলতে ২৫ জন ক্যান্ডিডেটকেই বোঝায়। ২১ তারিখে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে শুনি প্রথমে লিখিত পরীক্ষা হবে এবং পরে মৌখিক। ৩০ মিনিটে মাত্র ২০ নম্বরের চারটি রচনামূলক প্রশ্নের লিখিত পরীক্ষা নিয়ে মাত্র এক ঘণ্টা পরে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে মাত্র পাঁচজন ক্যান্ডিডেটকে মনোনীত করা হয়। ইমেইলের সিসি লিস্ট এবং ইন্টারভিউ থেকে এটা পরিষ্কার প্রার্থীর সংখ্যা ২৫ জন। অথচ লিখিত পরীক্ষার উত্তীর্ণের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে শেষের ক্যান্ডিডেটের ক্রমিক নং ২৬। আমার প্রশ্ন, এ ২৬ কোথা থেকে এলো? আমি লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাকি চারজনের ক্রমিক নম্বর ইমেইলে তাদের আইডির সাথে মিলিয়ে দেখলাম। আইডি তাদের ক্রমিক নং অনুযায়ী সাজানো, যেখানে ক্রমিক নং ২৬ এর কোনো অস্তিত্ব নাই। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এবং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যে এই প্রার্থীকে শেষ মুহূর্তে ঢোকানো হয়েছে, এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই। এই ২৬ নং প্রার্থীর ইস্যুতে পুরো রিক্রুটমেন্ট প্রসেস প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েরই তিনজন গ্রাজুয়েটকে বাদ দিয়ে নন পিএইচডি ও নন কেইউ গ্রাজুয়েটদের প্রহসনমূলক লিখিত পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে উত্তীর্ণ করা হয়। ২৫ জনের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া এবং মালেয়েশিয়ার মতো দেশের ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং ইউনিভার্সিটিতে এক্সচেঞ্জ পিএইচডি স্টুডেন্টস সুপারভাইজ করাসহ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থী রয়েছে। তাদের রয়েছে বিশ্বমানের ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা এবং গবেষণা প্রকাশনা। যোগ্যতার বিচারে কেন তাদেরকে মৌখিক পরীক্ষায় রাখা হলো না? শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পিএইচডিধারী এবং অনভিজ্ঞ মাস্টার্স পাস লোকের মধ্যে মূল্যায়ন কি মাত্র ২০ নম্বরের পরীক্ষার মাধ্যমে করা সম্ভব? মৌখিক পরীক্ষা বা ডেমো ক্লাসের মাধ্যমে কেবল একজন প্রার্থীর মূল্যায়ন করা সম্ভব, শুধুমাত্র ৩০ মিনিটে মাত্র ২০ মার্কের চারটি রচনামূলক প্রশ্ন দ্বারা নয়। সব উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এভাবেই শিক্ষক নির্বাচন করে থাকে। আমাদের সিস্টেম কেন উল্টো পথে হাঁটছে?
সবার কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, যে সিলেকশন পদ্ধতিতে শিক্ষক পদের জন্য পিএইচডি ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ক্যান্ডিডেট বাদ দেয়া এবং অনভিজ্ঞ ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট বা মাস্টার্স সিলেক্টেড হয় সেটা কি যোগ্যপ্রার্থী বাছাই পদ্ধতি নাকি যোগ্যপ্রার্থী ছাঁটাই পদ্ধতি? খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজিই ডিসিপ্লিনের গত ২১ ডিসেম্বর তারিখের শিক্ষক নিয়োগের এই প্রক্রিয়া এই ডিসিপ্লিনের ইতিহাসে একটি ন্যক্কারজনক এবং ঘৃণ্য ঘটনা হয়ে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। ধিক্ আপনাদের, ধিক্! এই জাতিকে মেধাশূন্য করতে ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর জাতির মেধাবীদের হত্যা করা হয়েছিল। আজ প্রায় ৫০ বছর পর সেই মেধাশূন্য করার কাজ আপনারা যতেœর সাথে এখনো করে যাচ্ছেন যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় যাওয়ার পথ বন্ধ করে। এবং এই কাজটা করার জন্য আপনারা যতটা পেরেছেন, নিচে নেমেছেন।
ভার্সিটির বিজিই ডিসিপ্লিনের একজন প্রবীণ শিক্ষক এ নিয়োগে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এবারের নিয়োগের যেসব ক্রাইটেরিয়া ডিসিপ্লিনের শিক্ষকদের সভায় ঠিক করা হয়েছিল তা মানা হয়নি। এমনকি ডিসিপ্লিনের সাবেক ডিন এ নিয়োগের বিরোধিতা করতে পারেন বলেই ১৭ ডিসেম্বর তার মেয়াদ শেষে ২১ তারিখে ইন্টাভিউয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।
এ ব্যাপারে ডিসিপ্লিনের বর্তমান ডিন ড. গোলাম কুদ্দুসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি প্রোভিসি নিয়োগের নতুন যে পদ্ধতি ঠিক করেছেন সে মতো আগে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। তাতে ফেল করায় পিএইচডি করা প্রার্থীরা বাদ পড়েছে। ভাইভায় আমি ছিলাম সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। সব কিছু স্বচ্ছভাবে হয়েছে। তবে ভেতরে কিছু আছে কি না তা আমার জানা নেই।

 


আরো সংবাদ



premium cement