রাস্তা পাকাকরণে ব্যবহৃত বিটুমিন আর আমদানি করতে হবে না
২০২১ সাল নাগাদ দেশের চাহিদা মিটিয়ে ৩-৪ লাখ টন রফতানি করা যাবে- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
রাস্তা পাকাকরণে ব্যবহৃত হয় জ্বালানি তেলের বাই-প্রোডাক্ট পণ্য বিটুমিন। দেশে সড়ক নির্মাণে যে পরিমাণ বিটুমিন প্রয়োজন হয়, এর ৯০ ভাগই আমদানি করতে হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। বাকি ১০ ভাগ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে। কিন্তু এখন থেকে আর আমদানি করতে হবে না হাইড্রোকার্বন পণ্য বিটুমিন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ২০২১ সালের মধ্যেই তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টন রফতানির লক্ষ্যে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন বিটুমিন প্ল্যান্টের যাত্রা শুরু করেছে। এটিই দেশের প্রথম বেসরকারি বিটুমিন প্ল্যান্ট।
সড়ক নির্মাণে উন্নত বিটুমিনের যোগান দিতে গতকাল শনিবার রোড টু দ্য ফিউচার স্লোগানে এই প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের এই বিটুমিন প্ল্যান্টের উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। উদ্বোধনের পরপরই এতে বিটুমিন উৎপাদন শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া ও কেরাণীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহান তানভীর, ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান সানভীর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর ও ওয়ালিদ সোবহান।
জানা যায়, বাংলাদেশে বিটুমিনের বার্ষিক চাহিদা পাঁচ থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড থেকে আসে বার্ষিক ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশের মতো সরকারি রিফাইনারি থেকে উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশে আর কোনো বিটুমিন প্ল্যান্ট না থাকায় অবশিষ্ট বিটুমিন আমদানি করতে হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ২০২১ সালের মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের এই বিটুমিন প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৯ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বছরে প্রায় তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টন বিটুমিন রফতানি করা যাবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিটুমিন নিয়ে আমরা অনেক যুদ্ধ করেছি, অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু সমাধান পাইনি। আমাদের আবহাওয়ার সাথে খাপ খায় এমন বিটুমিন আমরা পাচ্ছিলাম না। তা ছাড়া নানা কারণে গুণগত উৎকর্ষতা ধরে রাখতে পারতাম না। যে বিটুমিন ব্যবহার করতাম তা দিয়ে আমাদের রাস্তাগুলো টেকসই হতো না। প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলতেন, আমাদের রাস্তাগুলো কবে উন্নত দেশের মতো হবে? আজ আমরা আনন্দিত, বসুন্ধরা সে কাজটি করে দিচ্ছে। বসুন্ধরার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের আর বাইরে থেকে বিটুমিন আমদানি করতে হবে না। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও তারা এ পণ্য পৌঁছে দেবেন। এটাই বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন।
তিনি বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের এই উদ্যোগের কারণে আমি এখানে এসেছি, আপনাদের সবাইকে কাছ থেকে দেখতে পারছি। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের এই মাসে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আর কিছুদিন পরই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর শুভক্ষণ অপেক্ষা করছে। বসুন্ধরার এই উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সাথে জুড়ে রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এ কাজে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিটুমিন পাকা রাস্তা তৈরির অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। এর মানের উপর রাস্তার স্থায়িত্ব নির্ভর করে। বসুন্ধরা গ্রুপের এই বিটুমিন প্ল্যান্ট মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দেবে বলে আমি আশাবাদী।
নসরুল হামিদ বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অবদানের জন্যই দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ক্যাপটিভ ছাড়াই বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আট হাজার ৭১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃজনেও বেসরকারি খাতের অবদান লক্ষণীয়। গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারে বেসরকারি খাতের আরো কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সম্মিলিত উদ্যোগে আস্তে আস্তে বাংলাদেশ সোনার বাংলার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, আজ দেশের যে অবস্থান, বঙ্গবন্ধু থাকলে হয়তো ২৫ বছর আগেই এ অবস্থান আমরা পেতাম। আমাদের সব উৎসাহ ও উদ্দীপনার মূল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি, আজ সারা দুনিয়া বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপ এ পর্যন্ত ৩০টি শিল্পকারখানা স্থাপন করেছে, দুটি বিশাল হাউজিং করেছে। আমাদের গ্রুপের একটা বৈশিষ্ট্য বসুন্ধরা গ্রুপ শুধু নিজের জন্য করে না, মানুষের কথা ভেবে করে, মানুষ ও দেশের কল্যাণে করে। বসুন্ধরা গ্রুপে যারাই জমি কিনেছেন তারা আজকে মাল্টি মিলিনিয়ার। বসুন্ধরা গ্রুপের জমি কিনে যারা বিক্রি করেছেন তারাও সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছেন।
দেশের সার্বিক উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় আমরা যে কাজ শুরু করেছিলাম আজ তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেন। দেশে ব্যবসা করার পরিবেশ রয়েছে, সুযোগও বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে আমরা একটা হরতাল দেখিনি, অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনাও দেখিনি।
দেশে রেমিট্যান্স বেড়েছে উল্লেখ করে আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠালে ২ শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। এতে সঙ্গে সঙ্গে দেশের রেমিট্যান্স ১৫ শতাংশ বেড়ে গেল। আমি শুধু প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে বলব, আপনারা শুধু হুন্ডি বন্ধ করুন। দেখবেন-বর্তমানের তুলনায় রেমিট্যান্স ডাবল হয়ে যাবে। প্রতি মাসে দেশে তিন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সড়ক এবং মহাসড়ক বিভাগের অধীনে ২২ হাজার কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়ক রয়েছে। এর বড় অংশই সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরকার দেশের প্রতিটি জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া জেলাপর্যায়েও সড়ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সারা দেশে স্থানীয় সরকারের অধীনে তিন লাখ ৫৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ পাঁচ হাজার কিলোমিটার পিচঢালা পাকা রাস্তা। ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকারের পুরো রাস্তাই পাকা করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। ফলে দিন দিন বাংলাদেশে বিটুমিনের চাহিদা বাড়বে।
জানা যায়, বসুন্ধরা বিটুমিন কারখানাটি স্টেট অব আর্ট অবকাঠামো হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে রয়েছে উন্নতমানের সব সেবা ও সুযোগ-সুবিধা। ক্রেতাকে চাহিদা অনুয়ায়ী সময়মতো ড্রাম বা বাল্ক আকারে বিটুমিন সরবরাহ দেয়ার জন্য কারখানা এলাকায় দক্ষ ও মানসম্পন্ন সুযোগ-সুবিধার অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন কারখানাটি চাহিদা অনুযায়ী উন্নত গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করবে। কাটব্যাক, এমালসিফাইড, অক্সিডাইজড ও পলিমারসহ (এসবিএস, রাবার পাউডার) ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও সরবরাহে সক্ষম এই প্লান্ট। বসুন্ধরার এই প্ল্যান্ট থেকে বিটুমিনের পাশাপাশি জ্বালানি তেলসহ কিছু বাই-প্রডাক্টও উৎপাদন করা হবে।