১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশন

কাশ্মিরে রক্তগঙ্গা বইতে পারে : ইমরান

-

জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে শুক্রবার বক্তব্য রেখেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। দু’জনের বক্তব্যের প্রতি আলাদা দৃষ্টি ছিল বিশ্ববাসীর। বিশেষ করে কাশ্মির ইস্যুতে দু’জনের মতামত প্রত্যাশিত ছিল; কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এ বিষয়ে কোনো শব্দই উচ্চারণ করেননি মোদি। অন্য দিকে ইমরান খান সতর্ক করেন, অঞ্চলটিতে ‘রক্তগঙ্গা’ বইতে পারে। আলজাজিরা, রয়টার্স, এনডিটিভি।
তা ছাড়া দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পুরোদস্তুর যেকোনো যুদ্ধ বা সঙ্ঘাতের নেতিবাচক পরিণতি যে বিশ্বকেও ভোগ করতে হবে তা-ও ইমরান স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবার জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরে দেয়া বক্তব্যে ইমরান বলেন, ভারত অধিকৃত কাশ্মির থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নিলে সেখানে রক্তগঙ্গা বইবে। তিনি কাশ্মিরে মোদির পদক্ষেপকে ‘নির্মম’ ও ‘বোকামি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রসঙ্গত, আগস্টের শুরুর দিকে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেয় মোদি সরকার। এর পর থেকে অঞ্চলটিতে নজিরবিহীন অবরোধ জারি করে রাখা হয়েছে। সেখানে মোতায়েন রয়েছে কয়েক লাখ সেনা। এ ছাড়া পাকিস্তানের সাথেও নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে ভারতের। ভারতশাসিত কাশ্মিরিদের পক্ষে লড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইমরান। অন্য দিকে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। এতে পাকিস্তান যেন হস্তক্ষেপ না করে। এমতাবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে যুদ্ধের আশঙ্কাও করছেন।
ইমরান জাতিসঙ্ঘে আবেগঘন বক্তব্যে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হলে তা কেবল দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। কাশ্মিরে ৯ লাখ সেনা মোতায়েন করেছে ভারত। মোদির ভাষ্য, কাশ্মিরের সমৃদ্ধির জন্য এসব সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এই সেনারা সেখানে কী করবে? তাদের যখন প্রত্যাহার করা নেয়া হবে সেখানে তখন রক্তগঙ্গা বইবে। তিনি আরো বলেন, কারফিউ প্রত্যাহারের পর মোদি কী করবেন? তিনি কি মনে করেন যে, কাশ্মিরিরা চুপচাপ এই অবস্থা মেনে নেবে? কারফিউ উঠে গেলে যা হবে তা হচ্ছে, রক্তবন্যা বয়ে যাবে। মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। আর সেনারা কী করবে? তারা তাদের দিকে গুলি ছুড়বে... আরো মৌলবাদের দিকে ঝুঁকবে কাশ্মিরিরা। ইমরান বলেন, ‘আমার এ কথা ভুল হলে সর্বোত্তম কিছু ঘটার আশা করা যায়। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্যও তৈরি থাকতে হবে। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। আর পারমাণবিক অস্ত্রধর কোনো দেশ শেষ পর্যন্ত লড়ে গেলে এর পরিণতি সীমান্তের গণ্ডি পেরিয়ে যাবে। বিশ্বও এর ফল ভুগবে।’
অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘে নিজের বক্তব্যে সন্ত্রাসবাদ দমনের দিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন মোদি। কাশ্মির নিয়ে কোনো কথা উল্লেখ করেননি তিনি। মোদি বিশ্বনেতাদের বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান দৃঢ়। তিনি বলেন, আমরা এমন একটি দেশের মানুষ যারা যুদ্ধে নয়, শান্তির বার্তায় বিশ্বাস করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি শান্তি ও সংহতির বার্তা জানাচ্ছে। তিনি বিশ্বনেতাদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক হওয়ার আহ্বান জানান।
মোদির পরপরই বক্তব্য রাখেন ইমরান। তিনি বলেন, কাশ্মির ঘিরে নেয়া মোদির পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এই যুদ্ধ কেবল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটা কোনো হুমকি নয়, এটা একটা সতর্কতা। তিনি বলেন, পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো দেশ সব কিছু নিয়ে লড়াইয়ে নামলে, এর প্রভাব সীমান্তের বাইরেও পড়বে। পুরো বিশ্বকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায় এ অবস্থায় কী করবে?
ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, বিশ্বনেতারা কি ১২০ কোটি মানুষের একটি বাজারকে খুশি রাখবে? নাকি ন্যায় বিচার ও মানবতার পক্ষে সোচ্চার হবে? ইমরান বলেন, ‘যদি যুদ্ধ শুরু হয়েই যায় তবে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। কিন্তু ভাবুন, একটি দেশকে যখন তার চেয়ে সাত গুণ বড় প্রতিবেশীর সাথে যুদ্ধ নিয়ে ভাবতে হয়, আত্মসমর্পণ কর অথবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের স্বাধীনতার জন্য লড়াই কর। আমরা কী করব? আমি নিজেকেও একই প্রশ্ন করেছি। আমার বিশ্বাস এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই এবং আমরা লড়াই করব। ‘সে ক্ষেত্রে যখন একটি পরমাণু অস্ত্র শক্তিধর দেশ শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে, তখন যুদ্ধের ফলাফল সীমান্ত ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বকেই ভুগতে হবে।’ পাকিস্তানে কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের অস্তিত্ব নেই বলেও জানান ইমরান। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে, সন্ত্রাসবাদ কোনো একটি বিশেষ দেশের কাছে চ্যালেঞ্জ নয়, সব দেশ এবং মানবতার কাছেই চ্যালেঞ্জ। মানবতার জন্য সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বকে এক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ইমরান খান বলেন, জাতিসঙ্ঘের মনে রাখা উচিত ১৯৩৯ সালে ইউরোপ হিটলারের অপরাধকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির নাম করে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরএসএস নামে যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের আজীবন সদস্য, সেই সংগঠনের ‘আদর্শ হচ্ছে হিটলার ও মুসোলিনি’ এবং ওই আরএসএসই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। ইমরান খান কাশ্মির প্রসঙ্গে ভারত ও নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে চরম ক্ষুব্ধ ভারত।
উত্তর দেয়ার অধিকারের সুযোগ নিয়ে খানের ভাষণের পরপরই জাতিসঙ্ঘে ভারতের এক কূটনীতিক বিদিশা মৈত্র বলেন, ‘ইমরান খানের বক্তব্য উসকানিমূলক এবং পুরোপুরি মিথ্যা।’ তিনি বলেন, ইমরান খান জাতিসঙ্ঘের মতো আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মের ‘অপব্যবহার’ করেছেন। ‘একবিংশ শতাব্দীতে এসে ‘গণহত্যা’ ‘জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব’ ‘আমৃত্যু লড়াই’ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার মধ্যযুগীয় মানসকিতার বহিঃপ্রকাশ।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভাষণের প্রভাবে বিক্ষোভ শুরু হতে পারে এই আশঙ্কায় ভারত অধিকৃত কাশ্মিরজুড়ে লোকজনের চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পুলিশ। জাতিসঙ্ঘে ইমরানের ভাষণের পর শুক্রবার রাতে কয়েক শত কাশ্মিরি বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং ইমরানের সমর্থনে, কাশ্মিরের স্বাধীনতার সমর্থনে সেøাগান দেয়। এরপর শনিবার পুলিশের স্পিকার লাগানো ভ্যানগুলো শ্রীনগরের কয়েকটি এলাকায় ঘুরে ঘুরে লোকজনের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের কথা ঘোষণা করে, যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমনে রাস্তায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়; দুইজন প্রত্যক্ষদর্শী ও কর্মকর্তাদের বরাতে জানিয়েছে রয়টার্স। সৈন্যরা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে শ্রীনগরের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্রে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘গত রাতে ইমরান খানের ভাষণের পরই শ্রীনগর শহরজুড়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ায় এটি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল।’ শুক্রবার রাতে শ্রীনগরের নিকটবর্তী সৌরা অঞ্চলসহ কাশ্মিরের কয়েকটি এলাকায় রাস্তায় নেমে আসা লোকজন নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পাথর ছুড়ে তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয় বলে জানিয়েছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
তারপরেও জম্মু-কাশ্মিরের রামবন জেলায় পুলিশের গুলিতে অন্তত তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়া বন্দুকধারীদের সাথে গোলাগুলিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যও নিহত হয়েছে। গতকাল শনিবার সকালের দিকে রামবনে বেসামরিক এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে বন্দুকধারীদের সাথে ভারতীয় বাহিনীর গোলাগুলি হয়। জম্মু অঞ্চলের দায়িত্বরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেভেন্দর আনন্দ বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেন, আমরা বন্দুকযুদ্ধে তিনজনকে হত্যা করেছি। অভিযান শেষ হয়েছে। এই অভিযানে সেনাবাহিনীর এক সদস্যও মারা গেছে। জম্মু পুলিশের মহাপরিদর্শক মুকেশ সিং বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, জিম্মি দশার অবসানে অভিযানের সময় পুলিশের দুই সদস্যও আহত হয়েছে।
শনিবার সকালের জম্মু-কাশ্মিরের পৃথক তিনটি স্থানে বন্দুকযুদ্ধ ও গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। জম্মু-কাশ্মিরের শ্রীনগর মহাসড়কে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক পরে বন্দুকধারীদের একটি দল যাত্রীবাহী একটি বাস ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। পরে শ্রীনগর মহাসড়কের রামবনে পুলিশের সাথে তাদের গোলাগুলি হয় বেলা সাড়ে ১২টার দিকে।
এনডিটিভি বলছে, জম্মু-কাশ্মিরের শ্রীনগর মহাসড়কে যাত্রীবাহী চলন্ত বাসকে থামানোর চেষ্টা করেছে দুই-তিনজনের একটি দল। শ্রীনগর মহাসড়কের রামবান জেলার বাটোটের কাছে বাস থামানোর এই চেষ্টার পর সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে গোলাগুলি শুরু হয়। পরে ওই ব্যক্তি কিছুদূর বাস চালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশকে এ ঘটনা অবহিত করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। ওই এলাকায় কয়েকজন বন্দুকধারী একটি বাড়িতে ঢুকে একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে পণবন্দী করে বলে হিন্দুস্তান টাইমসের এক খবরে জানানো হয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী এনডিটিভিকে বলে, ‘আমি অন্তত দু’টি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি।’
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ও বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয় বিজেপি নেতৃত্বাধীন দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। এই পদক্ষেপকে ঘিরে কাশ্মিরজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত সেনা। এখনো আটক রয়েছে সেখানকার শত শত নেতাকর্মী। অভিযোগ উঠেছে, এর পর থেকেই সেখানে সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বেসামরিক মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় বাহিনী। নির্যাতনের শিকার হয়ে কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ভারত। কাশ্মিরে ভারতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে বহিষ্কারের পাশাপাশি দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কও স্থগিত করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement