ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির জটিলতার অবসান
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
- যুদ্ধবিরতির ২য় পর্যায়ের জন্য ইসরাইলের ৪ শর্ত
- ইসরাইলি কারাগারে ৫৯ ফিলিস্তিনির মৃত্যু
- ফের আল-আকসায় প্রবেশ ইসরাইলিদের
ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের মুক্তি বিলম্বিত হওয়া নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুরাহা হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস। কায়রো সফরে যাওয়া হামাসের একটি প্রতিনিধি দল এ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে গত মঙ্গলবার জানিয়েছে তারা। আলজাজিরা ও রয়টার্স জানিয়েছে, গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে চলমান বন্দিবিনিময়ের মধ্যেই ইসরাইলি বন্দীদের লাশ হস্তান্তরের পাশাপাশি একযোগে এ কারাবন্দীরা মুক্তি পাবেন বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে হামাস।
ফিলিস্তিনি এ স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি বলেছে, তাদের গাজাপ্রধান খলিল আল-হায়ার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির ‘প্রতিটি পর্ব, প্রতিটি ধারাসহ’ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। হামাস বলেছে, “প্রথম ধাপের সমঝোতা অনুযায়ী ইসরাইলি বন্দীদের লাশ হস্তান্তরের পাশাপাশি একযোগে তাদেরও (ফিলিস্তিনি কারাবন্দী) মুক্তি মিলবে, সাথে ছাড়া পাবেন আটক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুরাও”। গত ক’দিন ধরে ৬০০ ফিলিস্তিনির মুক্তি নিয়ে ইসরাইলের টালবাহানায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল; হামাস গাজায় ইসরাইলি বন্দীদের লাশ হস্তান্তরকে ‘পাবলিক শো’ বানিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করছে অভিযোগ করে তেল আবিব এ মুক্তি পিছিয়ে দিয়েছিল। হামাসের মঙ্গলবারের বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা অনেকটাই কেটেছে। তবে ইসরাইলের দিক থেকে এখনো ৬০০ ফিলিস্তিনির মুক্তি নিয়ে কোনো অবস্থান বা হামাসের বিবৃতির কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
মঙ্গলবার ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তারা আরো ৬৩ বন্দীকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে গাজা যুদ্ধবিরতির ৪২ দিনব্যাপী প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বিবেচনা করছেন। ফিলিস্তিনি এ ভূখণ্ডটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা পরে করা যাবে বলে জানান তারা। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় গত মাসে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে তার প্রথম এ ধাপটি শনিবার শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর কী হবে তা এখনো অজানা। হামাসের কর্মকর্তা বাসেম নাইম বলেছেন, কারাবন্দীদের আটকে রেখে এ যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও গাজা থেকে সব ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর।
৩৩ বন্দীর বিনিময়ে ইসরাইলি কারাগারে আটক দুই হাজারের মতো ফিলিস্তিনি বন্দী ও কয়েদিদের মুক্তি এবং গাজা থেকে আংশিক সেনাপ্রত্যাহারের শর্তে হওয়া চুক্তির প্রথম ধাপ বেশ কয়েকটি বাধা-বিপত্তির পরও টিকে আছে। ইসরাইল বলছে, তারা গাজার শাসনব্যবস্থায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা হামাসকে কোনো ভূমিকাতেই দেখতে চায় না। হামাস বলছে, গাজায় তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকতেই হবে এমন দাবি তারা করছে না; কিন্তু যা-ই হবে তা তাদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।
যুদ্ধবিরতির ২য় পর্যায়ের জন্য ইসরাইলের ৪ শর্ত
গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায় শেষের পথে; আর দু-তিন দিনের মধ্যে চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হওয়ার কথা। তবে সেই পর্বে প্রবেশের জন্য চারটি শর্ত রেখেছে ইসরাইল। যদি এই চার শর্ত পূরণ না হয়, সে ক্ষেত্রে চুক্তির প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর ব্যাপারটি পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে বলে জানিয়েছেন দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী এবং যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এলি কোহেন। গত মঙ্গলবার ইসরাইলি টিভি চ্যানেল কান-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে কোহেন বলেন, “যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের চারটি শর্ত রয়েছে। ক) ৭ অক্টোবর এবং তার আগে যেসব ইসরাইলিকে গাজায় বন্দী করা হয়েছিল, তাদের সবাইকে মুক্তি দিতে হবে; খ) গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী হামাসকে গাজা থেকে বিদায় নিতে হবে; গ) গাজা উপত্যকাকে অবশ্যই সম্পূর্ণ অস্ত্রমুক্ত করতে হবে এবং ঘ) পুরো গাজা এলাকায় ইসরাইলের নিরাপত্তাসংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে।”
ইসরাইলি কারাগারে ৫৯ ফিলিস্তিনির মৃত্যু
ইসরাইলি কারাগারে কমপক্ষে ৫৯ ফিলিস্তিনি বন্দী মারা গেছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে বিপুলসংখ্যক এই ফিলিস্তিনি ইসরাইলি কারাগারে প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত ফিলিস্তিনিদের বেশির ভাগই অবরুদ্ধা গাজা ভূখণ্ডের বাসিন্দা। গত মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু। বার্তাসংস্থাটি বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি কারাগারে কমপক্ষে ৫৯ ফিলিস্তিনি বন্দী মারা গেছেন বলে বন্দীদের অধিকার বিষয়ক একটি গ্রুপ মঙ্গলবার জানিয়েছে। প্যালেস্টানিয়ান প্রিজন সোসাইটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে গাজা উপত্যকার ৩৮ জন বন্দী রয়েছেন। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাজার বন্দীদের মৃত্যুর তথ্য গোপন করার অভিযোগও করেছে সংস্থাটি।
বন্দিবিষয়ক কমিশন সোমবার জানিয়েছে, গাজার বন্দী মুসাব হানি হানিয়াহ ইসরাইলি হেফাজতে মারা গেছেন। ৩৫ বছর বয়সী হানিয়াহকে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুস থেকে ২০২৪ সালের ৩ মার্চ আটক করেছিল ইসরাইলি সেনাবাহিনী। তার পরিবারের মতে, আটক হওয়ার আগে হানিয়াহ সুস্থ ছিলেন।
ফিলিস্তিনি পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৬৭ সালে পশ্চিমতীর এবং গাজা দখলের পর থেকে ইসরাইলি কারাগারে কমপক্ষে ২৯৬ ফিলিস্তিনি বন্দী মারা গেছেন। অন্তত ১০ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরাইলের কারাগারে বন্দি রয়েছে। এই পরিসংখ্যানে গাজা উপত্যকা থেকে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি যাদের সংখ্যা আনুমানিক হাজার হাজার।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার ৩৫০ জনে পৌঁছেছে বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরো লক্ষাধিক মানুষ। জাতিসঙ্ঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।
ফের আল-আকসায় প্রবেশ ইসরাইলিদের
এ দিকে ফের আল-আকসা মসজিদের প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েছে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের একটি দল। অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমের এই পবিত্র স্থানে এর আগেও বহুবার তারা এ ধরনের কাজ করেছে। জোর করে তারা আল-আকসা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে কাছাকাছি একটি স্থানে তালমুদিক প্রার্থনায়ও অংশ নিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী একটি চুক্তির আওতায় সেখানে ইসরাইলিদের প্রার্থনা এবং তালমুদিক রীতি পালন নিষিদ্ধ। কিন্তু বারবার এই চুক্তি লঙ্ঘন করছে বসতি স্থাপনকারীরা।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের উগ্র ডানপন্থী মন্ত্রীরা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, তারা এই মসজিদ প্রাঙ্গণ দখল করে সেখানে একটি সিনাগগ নির্মাণ করতে চান। জেরুসালেম ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের ১০০ বছরের সহিংসতার ইতিহাসের সাক্ষী। মুসলিম ও ইহুদি, দুই ধর্মাবলম্বীর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত আল-আকসা মসজিদ। দুই ধর্মাবলম্বীই আল-আকসাকে নিজেদের বলে দাবি করেন।
মুসলিমদের জন্য তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান এটি। মসজিদ চত্বরটি মুসলিমদের কাছে হারাম-আল-শরীফ হিসেবেও পরিচিত। অন্য দিকে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা আল-আকসা মসজিদ ও তার আশপাশের অংশকে ‘টেম্পল মাউন্ট’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তাদের জন্য এটি বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থান।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ আল-আকসা মসজিদ ঘিরে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। ইসরাইল এ যুদ্ধে জয়ী হয়। তারা গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়, যা ১৯৪৮ সাল থেকে মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্য দিকে পূর্ব জেরুসালেমসহ পশ্চিমতীরও তারা দখল করে নেয় জর্দানের কাছ থেকে। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত জর্দানের ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধায়ক ছিল। এরপর ইসলামী ওয়াকফ ট্রাস্টের হাতে মসজিদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। শুধু মুসলমানরাই আল-আকসার ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন। তবে ইহুদিরা পশ্চিম দেওয়ালে প্রার্থনার জন্য অংশ নেন। পুরো মসজিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। স্থানীয়দের অভিযোগ, ১৯৬৭ সালে ইসরাইল, জর্দান এবং মুসলিম ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সম্মত হওয়া ব্যবস্থাকে বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষা করে আসছে ইসরাইলিরা। তারা সেখানে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা