বিগত সরকারের সময়ে দেশের অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছিল
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০২

বিগত সরকারের সময়ে দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছিল। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও অর্থ পাচার এ দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং সেক্টর ও নানা অবকাঠামো নির্মাণে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে আমাদের রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আর সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান বলেছেন, রফতানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে পরিপক্ব হওয়ার পর সেগুলো রফতানিতে পাঠানো যেতে পারে। টাস্কফোর্সের কাছে প্রত্যাশা ছিল, সংস্কার কেন আটকে যায়, তার ব্যাখ্যা থাকবে। আমীর খসরু বলেন, ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারে সংস্কার আনতে হবে। এটাকে ধ্বংস করা হয়েছে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ‘অর্থনীতির কৌশল পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে টাস্কফোর্সের সুপারিশ’ সংক্রান্ত কনফারেন্সের প্রথম দিনের উদ্বোধনী সেশনে গতকাল প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে টাস্কফোর্স যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা এখনো হাতে পাননি বলেও বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান। বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ড. কে এ এস মুরশিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধূরী, সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ফিকির প্রেসিডেন্ট ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আক্তার, পিকার্ড বাংলাদেশের ডিএমডি অমরিতা ইসলাম, টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ড. সেলিম রায়হান ও ড. মোহাম্মদ এ রাজ্জাক।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বলেন, আমাদের বেশির ভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আসে। শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমানো ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানি বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, গত সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। ওই সময় বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, একসময় যেভাবে তৈরী পোশাক শিল্পের বিকাশ হয়েছিল, এখন সেভাবে তা হবে না। সে কারণে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও রফতানি সম্প্রসারণে জোর দেন।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, চীন তার শিল্পায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছিল কারণ তাদের বিলিয়ন ডলারের একটি অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল। চীনে আসা এফডিআইয়ের প্রধান প্রাথমিক আকর্ষণ ছিল চীনা বাজারে প্রবেশ করা। তিনি বলেন, অটোমোবাইল নির্মাতাদের সবাই চীনে এসেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে চীনকে অটোমোবাইলের বৃহত্তম প্রস্তুতকারক বানিয়েছিল। চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার এর প্রধান আকর্ষণ ছিল। ইলেকট্রনিক গাড়ির ক্ষেত্রে চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম রফতানিকারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তিনি বলেন, সর্বোপরি, আপনার যদি সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ থাকে এবং এই অভ্যন্তরীণ বাজার প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, এটি অবশ্যই একটি খুব আকর্ষণীয় বাজার। যারা বাংলাদেশে এফডিআই নিয়ে এসেছে তারাও সেই বাজারকে লক্ষ্য করে এসেছে। তাই এই বাজার পর্যাপ্তভাবে কাজে লাগানো হয়েছে কি না, কোনো গুণগত উন্নতি করা যেতে পারে কি না এ বিষয়ে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, বাইসাইকেল, ইলেকট্রনিক এবং এ ধরনের পণ্যসহ এমন অনেক শিল্প রয়েছে যা পরিপক্বতা অর্জন করেছে এবং রফতনিতে পরিপক্বতা পাচ্ছে।
সিপিডি চেয়ারম্যান বলেন, রফতানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে গত ৩০ বছরে যে বিষয়গুলো বিকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এখনো তার সমাধান হয়নি। যতক্ষণ না আপনি সঠিকভাবে এটি নির্ণয় করতে পারবেন, ততক্ষণ আপনি ভবিষ্যতের জন্য সত্যিকারের নীতি সংস্কারের পরামর্শ দিতে পারবেন না। তাই এটি একটি বড় অমীমাংসিত সমস্যা। একাডেমিক গবেষণা এবং সরকারি নীতি প্রণয়ন উভয় স্তরেই প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, চামড়া শিল্পের সমস্যা, আরএমজির বহুমুখীকরণ এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ সম্পর্কিত সমস্যা। এই সমস্যাগুলো শুধু সাধারণভাবে আলোচিত হয়নি, বিশেষ টাস্কফোর্স গভীরভাবে এই সমস্যাগুলোর ওপর বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে কাজ করেছে তিনি বলেন।
সিপিডি চেয়ারম্যান বলেন, আমি খুশি যে টাস্ক ফোর্সের প্রতিবেদনে মাঝারি এবং ক্ষুদ্র পরিসরের এমএসএমইগুলো কিভাবে তাদের পণ্যের মান উন্নয়ন করতে পারে, রফতানি খাতের সাথে যুক্ত করতে পারে এবং সাপ্লাই চেইনে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তৈরির মাধ্যমে পণ্যগুলোর উৎপাদনশীলতা এবং গুণমান যোগ করতে পারে- এ সংক্রান্ত সুপারিশ আছে। তিনি বলেন, আমি বলব যে আমরা সবাই দীর্ঘকাল ধরে এফডিআই নিয়ে কথা বলি এবং আমরা সত্যিই এফডিআই আকর্ষণ করতে সক্ষম হইনি। বাংলাদেশে থাকা এফডিআই বিনিয়োগকারীদের সাথে নিবিড় কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের সমস্যা শুনে তা সমাধানে অগ্রসর হওয়া উচিত।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিগত সময়ে যাদের পেট্রোনাইজ করা হয়েছে তারা মার্কেটে টিকে ছিল। আমাদের সার্বিকভাবে ম্যাইক্রো ইকোনমি নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশের অর্থনীতি সংশোধন করতে হয়েছে। অর্থনীতিকে পুনঃশোধন (রিসেট) করতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারকে তার গতিতে চলতে দিতে হবে। মেজর ডিরেগুলেশন প্রয়োজন।
ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ওপরে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আমীর খসরু বলেন, রফতানি ও অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় বাধা রেগুলেশন। ফ্রি মার্কেটের কথা বলে ব্যবসায় বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। বাজারকে উদার করতে হবে। বেসরকারি খাত থেকে রাজস্ব আসবে। ইজি অব ডুয়িং বিজনেস বাড়াতে হলে ডিরেগুলেশন করতে হবে।
উদাহরণ টেনে খসরু বলেন, আমি যখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ছিলাম পোশাকে ইউডি এটা ইপিবিতে ছিল। ইপিবিতে থাকলে যা হয়, ওখানে আমলাতন্ত্র আছে-দুর্নীতি হয়। রফতানিকারকরা আমার কাছে এলেন। তাদের বললাম, এটা যদি ইপিবি থেকে নিয়ে বিজিএমইএতে দিয়ে দেই, আপনারা কী নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন? তখন ব্যবসায়ীরা রাজি হলেন। আমি এটা ইপিবি থেকে বিজিএমইএকে দিলাম। আজ পর্যন্ত এটা ভালোভাবে চলছে। অনেকগুলো কাজ, সরকার যেগুলো করছে তার কিছু বের করে এনে ট্রেড বডিকে দিয়ে দিতে হবে।
মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখনই সরকারের উচিত চিফ ট্রেড নেগোসিয়েটর অফিস তৈরি করা। যাতে ট্রেড পলিসিকে ওয়েল কর্ডিনেট করা যায়। প্রত্যেক জায়গায় যাতে সমন্বয় করা যায়।
সেলিম রায়হান বলেন, পোশাকের বাইরে শ্রমঘন শিল্পে আমাদের যেতে হবে। দক্ষতাভিত্তিক পণ্য ও সেবার দিকে আমাদের যেতে হবে। পোশাক খাতেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। আমাদের নীতিমালাগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। আমরা দেখি একটি নীতি রফতানিকে উৎসাহিত করে, আবার আরেকটা নীতি রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা