২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৫ শাবান ১৪৪৬
`

বন্দীদের মুক্তি ছাড়া আলোচনা করবে না হামাস

-

- পশ্চিম তীরে ইসরাইলি ট্যাংক
- যুদ্ধ ফের শুরুর হুমকি নেতানিয়াহুর

যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে ইসরাইলকে। তা না হলে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী ধাপ নিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইসরাইলের সাথে আলোচনা করবে না হামাস। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের কর্মকর্তা বাসেম নাঈম রয়টার্সকে এ কথা বলেন। হামাসের রাজনৈতিক শাখার সদস্য নাঈম বলেন, “শত্রুদের সাথে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার শর্ত হলো : আগে ৬২০ বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। যাদের ছয় ইসরাইলি বন্দী এবং চার বন্দীর লাশ ফেরত দেয়ার বিনিময়ে মুক্তি দেয়ার কথা ছিল। এই বন্দীদের শনিবারেই হস্তান্তর করা হয়েছে।”

যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সেসব শর্ত উল্লেখ রয়েছে, শত্রুরা যেন তা মেনে চলে সেটি মধ্যস্থতাকারীদের নিশ্চিত করতে হবে বলে দাবি জানান নাঈম। যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে গত শনিবার ছয় ইসরাইলিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। চার বন্দীর লাশও হস্তান্তর করে তারা। এর বিনিময়ে ওই দিনই ইসরাইলের কারাগার থেকে ৬২০ ফিলিস্তিনি কারাবন্দীর মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তুফিলিস্তিনি
কারাবন্দীদের মুক্তি পিছিয়ে দিয়েছে ইসরাইল। রোববার ভোরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দফতর থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অপমানজনক অনুষ্ঠান ছাড়া পরবর্তী বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ইসরাইল ৬২০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে পাঠানোর অপেক্ষায় থাকবে। ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি দেয়ার আগে তাদের অনেক লোকজনের সামনে মঞ্চে উঠাচ্ছে হামাস আর রেড ক্রসের কাছে হস্তান্তরের আগে কখনো কখনো তাদের দিয়ে বক্তব্য দেয়াচ্ছে। নিহতদের কফিনগুলো ভিড়ের মধ্য দিয়ে বহন করে নিয়ে গেছে। এসব নিয়েই আপত্তি তুলেছে ইসরাইল।
ইসরাইল ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি পিছিয়ে দেয়ায় বন্দীদের পরিবারগুলো হতাশ হয়ে পড়েছে। ইসরাইলের কারাগার থেকে শনিবার ভাইয়ের মুক্তি পাওয়ার আশায় ছিলেন গাজার এক বাসিন্দা। তিনি বলেন, প্রতিবার কারাগার থেকে বন্দী মুক্তির তালিকা দেয়া হয়। তারা অপেক্ষায় থাকেন এবার হয়তো ভাইয়ের নাম তাতে থাকবে, কিন্তু কখনো তার নাম থাকে না। কিন্তু এবার যখন শেষ পর্যন্ত মুক্তির তালিকায় ভাইয়ের নাম এলো তখন ইসরাইল চুক্তি স্থগিত করে দিলো। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলছে। এর প্রথম পর্বে যে ৩৩ জনকে হামাসের মুক্তি দেয়ার কথা ছিল তা তারা সম্পন্ন করেছে।

পশ্চিম তীরে ইসরাইলি ট্যাংক : এ দিকে ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীরে ট্যাংক প্রবেশ করিয়েছে ইসরাইল। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের শরণার্থীশিবিরগুলোতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে সেনাবাহিনীকে ‘দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান’ গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে দেশটি। এই অবস্থায় ইসরাইল পশ্চিম তীরকে গাজার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে পরিণত করতে পারে। রয়টার্সের খবর থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ইসরাইলের এই পদক্ষেপের পর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, পশ্চিম তীরকে হয়তো আরেকটি গাজায় পরিণত করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের তরফ থেকে এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এলো যখন গাজায় চলমান ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। হামাস চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত ছয় জিম্মিকে মুক্তি দিলেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ছয় শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তি প্রক্রিয়া স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন। গত এক মাসে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সামরিক অভিযানের ফলে এরই মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জেনিন ও তুলকারেমের মতো শহরগুলোর শরণার্থীশিবিরগুলোতে অভিযান চালিয়ে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে দাবি করেছে।

এই শরণার্থীশিবিরগুলোতে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় যে ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের বংশধরেরা বসবাস করছেন। ইসরাইলের দাবি- গত কয়েক দশক ধরে এসব শিবিরই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর শক্ত ঘাঁটি। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ জানিয়েছেন, প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনিকে এসব শিবির থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং শিবিরগুলো এখন খালি রয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
এ দিকে নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীকে অভিযান আরো জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ গত বৃহস্পতিবার তেলআবিবের কাছে পরিবহন ডিপোগুলোতে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসব বিস্ফোরণে কেউ হতাহত না হলেও, দুই দশক আগের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় শত শত ইসরাইলির মৃত্যুর স্মৃতি স্মরণ করছে ইসরাইলি নীতিনির্ধারকেরা।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদাইনা পশ্চিম তীরে ট্যাংক মোতায়েনের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘এটি একটি বিপজ্জনক ইসরাইলি উসকানি, যা স্থিতিশীলতা বা শান্তি বয়ে আনবে না।’
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা জেনিন, তুলকারেম ও নুর শামস শরণার্থীশিবিরে অভিযান চালিয়ে ২৬ জন ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করেছে এবং তিনটি বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্র জব্দ করেছে। তারা অভিযানের পরিধি বাড়িয়ে নাবলুস, কাবাতিয়া ও দক্ষিণের দেইর কাদ্দিস পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো গুঁড়িয়ে, এমনকি রাস্তা খুঁড়ে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। রোববার ইসরাইলি যুদ্ধট্যাংকগুলোকে পশ্চিম তীরের জেনিনের দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেছে।
গাজায় ৪২ দিনব্যাপী যুদ্ধবিরতি চলাকালে এবং লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান স্থগিত থাকায়, ইসরাইলি নজর এখন ক্রমেই পশ্চিম তীরে সরে এসেছে। ইসরাইলি সেনারা সবসময়ই পশ্চিম তীরে সক্রিয় থাকলেও এবার সাঁজোয়া যানসহ ভারী ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। এই বিষয়টি প্রমাণ করে যে, তারা স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর ওপর আরো বেশি চাপ প্রয়োগ করছে।

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানে পশ্চিম তীরে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পশ্চিম তীরে ইসরাইলের অভিযান পরিচালনার বিষয়টি মূল্যায়ন করতে গিয়ে লেবেক রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির গোয়েন্দা প্রধান মাইকেল হোরোভিটজ বলেন, পশ্চিম তীরে ট্যাংক মোতায়েন ‘যুদ্ধবিরতির জন্য খুবই স্পর্শকাতর সময়ে’ ঘটছে। তিনি উল্লেখ করেন, নেতানিয়াহু দেশীয় চাপে রয়েছেন। তার যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে এবং তিনি হয় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করবেন বা তার কট্টর-ডানপন্থী জোট সরকারের পতনের ঝুঁকি নেবেন।
২০০২ সালে শেষবার পশ্চিমতীরে সাঁজোয়া যান পাঠিয়েছিল ইসরাইল। সেবার শক্ত হাতে ফিলিস্তিনি আন্দোলন দমন করেছিল তেলআবিব। ইসরাইলের সাম্প্রতিক অভিযানকে অবৈধ আগ্রাসন হিসেবে নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ আহ্বান করেছে ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইসরাইলি সেনাদের অভিযানে পশ্চিম তীরের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে তারা।
নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি : এ দিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যেই গাজায় আবারো যুদ্ধ শুরুর হুমকি দিয়েছেন দখলদার ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। রোববার দেশটির সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে নেতানিয়াহু এ হুমকি দেন। এ সময় তিনি আরো জানান, হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার যে লক্ষ্যমাত্রা তারা ঠিক করেছেন, সেটি অর্জন করবেনই। হোক সেটি ‘আলোচনার মাধ্যমে’ অথবা ‘অন্য কোনো উপায়ে’। নেতানিয়াহু বলেন, আমরা যেকোনো মুহূর্তে তীব্র যুদ্ধ শুরু করতে প্রস্তুত আছি। গাজায় আমরা হামাসের সঙ্ঘবদ্ধ বাহিনীকে শেষ করে দিয়েছি। কোনো সন্দেহ থাকবে না, আমরা যুদ্ধের সম্পূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করব।

 


আরো সংবাদ



premium cement