জ্বালানি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা : ১৫ বছরে একটি কূপও খনন হয়নি
ইআরএফ ও পলিসি এক্সচেঞ্জের আলোচনা- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
প্রতি বছর চারটি করে কূপখননের পলিসি ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরের নতুন কূপখননের জন্য তেমন কিছুই খরচ হয়নি, তৈরি হয়নি নতুন কোনো নীতিমালাও। যা দেশের গ্যাস সঙ্কটের অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। আর ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশের অর্থনীতিকে ধরে রাখতে হলে গ্যাসের দাম বর্তমানের চেয়ে কমানো দরকার। গ্যাসের দাম কমাতে হবে, না হলে দেশে শিল্প থাকবে না। মূলত আমরা ফেঁসে গেছি। অপর দিকে অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ বলেছেন, গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হলে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে, চাপে পড়বে অর্থনীতি। অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা জ্বালানি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছি।
রাজধানীর ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেলে গতকাল পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পলিসি কন্সিডার ইন এনার্জি অ্যার্ফোডেবিলিটি অ্যান্ড ইমপেক্ট অন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপেটিটিভনেস শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলা হয়। ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন ও সঞ্চালনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. মাসরুর রিয়াজ। প্রধান অতিথি ছিলেন বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। বক্তব্য রাখেন- বুয়েটর প্রকৌশল বিভাগের ডিন অধ্যাপক ইজাজ হোসেন, বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, ফরেন চেম্বারের (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার, নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হোসাইন, ইউরোচেমের প্রেসিডেন্ট নুরিয়া রোপেজ, ব্যারিস্টার তানিম হোসাইন শাওন।
ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। কমবে প্রতিযোগিতর সক্ষমতা। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সাথে সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে। ফলে আর্থিক খাতে চাপ পড়বে। আমদানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি লাগবে। অনেক শিল্প বন্ধ হবে, তখন মন্দ ঋণ বাড়বে।
তিনি বলেন, আমাদের কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি। কর্মসংস্থানে বিনিয়োগ আসছে না। কমে যাচ্ছে। আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগ ২৩/২৪ শতাংশের মধ্যে আছি। এটাকে ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশে নিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের করনীতি দেশী-বিদেশী সবাইকে হয়রানি করছে। রাজনৈতিক কারণে আমাদের দেশে গত ১২ বছরে নতুন করে কোনো গ্যাস ক্ষেত্র উদ্ভাবন করা হয়নি। তিনি বলেন, সিস্টেম লস বা চুরি যেখানে ৬ শতাংশ বলা হচ্ছে, সেটা কমিয়ে ১ শতাংশে আনা গেলে অনেক সাশ্রয় হবে।
তথ্য তুলে ধরে ড. মাসরুর বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সিরামিক্স খাতে ব্যয় ৩৫ শতাংশ বাড়বে। স্টিল খাতে ৩০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিমেন্ট খাতের ব্যয় ১২ শতাংশে উন্নীত হবে। নন পারফরমিং লোন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি সুপারিশে বলেন, দাম বাড়ালে উৎপাদন খরচ বাড়বে, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমবে, রফতানি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাবে, দেশীয় বাজার এবং ভোক্তা ক্রয় ক্ষমতার উপর চাপ পড়বে, আর্থিক চাপ ও বেকারত্ব বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়বে, নতুন বিনিয়োগ, সম্প্রসারণ পরিকল্পনা এবং শিল্প বৃদ্ধিতে বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং দুর্নীতির সুযোগ উন্মুক্ত করা হবে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, জ্বালানি সঙ্কট সব সময় ছিল না। তিতাসের গ্যাস এক সময় কেউ নিত না। ২০০৭ সালে বিবিয়ানা উৎপাদনে আসে। তখন গ্যাসের মার্কেট ছিল না। ফলে ইটের ভাটাতে গ্যাস দেয়া হয়। তখন বলা হলো দেশ গ্যাসে ভাসছে। তখন যদি গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করতাম তাহলে এখন সয়ে যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। আমরা বেশি দামে এলএনজি আনছি। কিন্তুএলএনজি আমদানির চেয়ে কম খরচে দেশে অনুসন্ধান করা সম্ভব ছিল। নেপাল থেকে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করব।
অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের ডলারের অবস্থা করুন। অন্য খাত থেকে গ্যাস সরিয়ে দেশ ও ডলারের খাতিরে শিল্প খাতে দেয়া উচিত। ৭৫ টাকা দর হলে হবে অযৌক্তিক। যারা এরইমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভারতে বেশি ভাগ শিল্পে কয়লাতে চলে। আমাদের দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, জ্বালানি ছাড়া কোনো শিল্প সম্ভব নয়। জ্বালানি হলো যেকোনো দেশের অর্থনীতির জীবন। সস্তা গ্যাসের কারণে দেশে শিল্প কারখানা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি, এনবিআরেও অন্য সমস্যা আছে। আরেকদিকে গ্যাসের দাম বাড়তি। তার পরও চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারছে না। সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ গ্যাস দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। আমরা কেউ আর শিল্প করতে চাই না। তবে শিল্পকে সহায়তা করবেন না- এটা হতে পারে না। দেশের অর্থনীতিকে ধরে রাখতে হলে গ্যাসের দাম বর্তমানের চেয়ে কমানো দরকার।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস ছাড়া দেশে শিল্প টিকবে না। যদি গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো হয় তাহলে দেশে শিল্প থাকবে না। গ্যাস সঙ্কট শিল্পের জন্য হুমকি।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের দাম বাড়বে এটা নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। গ্যাসের বর্তমান দাম কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা দরকার। কমিশন খাওয়ার জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল বিগত সরকারের লোকজন। তারা বিদেশে বসে এখনো কমিশন খাচ্ছে। দাম কমানো না গেলে শিল্প থাকবে না। মূলত আমরা ফেঁসে গেছি। আমাদের গড়া শিল্প অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছি। তিতাস কেন প্রফিট করবে?
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, কিছু ব্যাংককে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, কারণ ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে টাকা দেয়া হলেও শিল্প টিকিয়ে রাখার দিকে মনোযোগ নেই। ব্যাংক ঋণের সুদ হার ১৮ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি মূলধন অর্ধেক কমে গেছে। তিনি বলেন, দেশে এতগুলো চিনিকল থাকতেও পাকিস্তান থেকে চিনি আমদানি হচ্ছে, এটা লজ্জাজনক। এই আমদানির কারণে কিন্তু কর্মসংস্থান হবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে বিপদ বাড়ছে। ব্যারিস্টার তানিম হোসাইন শাওন বলেন, আইনের শাসন না থাকলে কোনো ধরনের বিনিয়োগই দেশে আসবে না। বিগত সরকারের আমলে দেশে আইনের শাসন ছিল না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা