২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯ ফাল্গুন ১৪৩০, ২২ শাবান ১৪৪৬
`
৩৬ জুলাইয়ের বিপ্লবগাথা

নামাজের মধ্যে তাহিরের কফিনমাখা মুখ দেখতে পান মা

নামাজের মধ্যে তাহিরের কফিনমাখা মুখ দেখতে পান মা -

ছোট বেলা থেকেই কবিতা রচনা, আবৃত্তি, গান চর্চা, বক্তা হিসেবে পটু ছিলেন তাহির। তাহিরের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি রংপুর শহরের আল হেরা স্কুলে। শৈশবে মায়ের হাত ধরে হয়তো দুষ্টুমির জন্যে বকুনি খেতে খেতে ছুটতেন শিশু সংগঠন ফুলকুঁড়িতে। পড়াশুনার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান শেখা আর সংস্কৃতি চর্চার ভেতর দিয়ে ভিন্ন এক আখলাকের বৈশিষ্ট্য পেয়ে যান তাহির। ধর্মভীরু আদর্শ পিতা-মাতা ছোটবেলা থেকেই তাহিরকে কুরআন হাদিসের আলোয় বড় করে তুলেছেন।
শৈশব শেষে ঢাকায় যখন পড়াশুনা করতে আসেন তখনো সংস্কৃতি চর্চাকে ধরে রেখেছিলেন তাহির। যে কারণে উচ্চারণ শিল্পীগোষ্ঠীর সহকারী পরিচালক হয়েছিলেন। ছন্দের মাধুর্য খেলা করতে তার মননে। আর তা কখনো পরিপূর্ণ কবিতায় রূপ পেত, ছড়া ও গানে সঙ্কলিত হতো। ঢাকার সিরামিকস ইনস্টিটিউটে সিভিল ডিপার্টমেন্টে অষ্টম সেমিস্টারে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। চালিয়ে যাচ্ছিলেন মানে তাহিরের বাবা স্ট্রোক করার পর থেকে পরিবারটি অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে যায়। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার মতো ছেলে ছিলেন না তাহির। বাড়িতে সংসারের হাল ও চুলায় রান্নার আয়োজন করতে তাহিরের মা’কে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কুরআন শরিফ পড়াতে হতো। তাহির সংসারের এই অবস্থা বুঝে কেমন করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চাইবেন অসুস্থ বাবা আর মায়ের কাছে। কখনো আতর বিক্রি, কখনো টুপি বা ইয়ার ফোন বিক্রি করতেন। কারণ এর চেয়ে দামি পণ্য বিক্রির মূলধনও ছিল না তাহিরের।

তাহিরের আতরের খুশবু, তার টুপি পরে সিজদায় নতজানু কারো দোয়া হয়তো তার জীবনে পাথেয় হয়ে ফিরে এসেছিল। তা না হলে এমন গৌরবের মৃত্যু কয়জন পায়। যে ছেলে বেড়ে উঠেছে দ্বীনের উদ্ভাসিত আলোয়, মস্তিষ্কে আর মননে যার ঈমানী চেতনা সে কিভাবে ঘরে বসে থাকতে পারে? তাহিরও পারেনি। কিভাবে পারত তাহির? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাকে জেল, জুলুম, হত্যা ও গুমের শিকার হতে হয়। এই জীবনের জন্যে তো তাহির নিজেকে গড়ে তোলেননি। কোটার নামে মেধাবীদের বৈষম্যের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে বারবার দেখেছেন তাহির। তাই তাহির সক্রিয়ভাবে শিক্ষার্থীদের সাথে সরকারবিরোধী মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। কারফিউ জারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা তাহিরকে আন্দোলন থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ১৯ তারিখ শুক্রবারে আন্দোলনের অন্যান্য দিনের মতো তাহির বাসা থেকে সকাল ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে রংপুর সিটি করপোরেশন রাম মোহন রায় মার্কেটের সামনে সঙ্গীদের সাথে অংশ নেন। উত্তাল আন্দোলনের ফাঁকে জুম্মার নামাজ আদায় করে ফের বিকেলে রাজপথে নামেন তাহির। সাথে অকুতোভয় অন্যান্য সহযোদ্ধা। অন্য দিকে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসী নেতা কর্মীরা একযোগে নিরীহ সাধারণ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলি চালাতে থাকে মুহুর্মুহু। একসময় ঘাতক পুলিশের একটি বুলেট তাহিরের পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়া তাহিরকে সহযোদ্ধারা কোলে করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তাহিরের মায়ের কানে ততক্ষণে পৌঁছে গেছে এই দুঃসংবাদ। হাসপাতালে গিয়ে তাহিরের মা দেখেন আরো অসংখ্য আহত তরুণরা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। লাশের সারিতে সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তাহির ৬-৭ ঘণ্টা। রাত ১১টায় তাহির সহযোদ্ধাদের শহীদি কাফেলায় যোগ দেন। শহীদ আব্দুল্লাহ আল তাহির শৈশবে গানের পাখি থেকে, কবি থেকে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রূপান্তরিত হন আগামী দিনের উজ্জ্বল নক্ষত্রে। মহান আল্লাহ তার শাহাদাতকে কবুল করুন।

 


আরো সংবাদ



premium cement