সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪তম
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। গত ২০২৩ সালে এই অবস্থান ছিল দশম। গত ১৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম স্কোর ২৩ পেয়েছে এবার। গতবার ছিল ২৪। দেশে দুর্নীতি কমেছে, তা নয়। বরং বাংলাদেশ নম্বর আরো কম পেয়েছে। ২০২৩ সালে ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৪, গত বছর পেয়েছে ২৩। দুর্নীতি বাড়ায় বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে এক কমেছে। কিন্তু অন্য দেশ আরো খারাপ করায় সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে ডেনমার্কে সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির মাত্রা ছিল দক্ষিণ সুদানে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা গভীর উদ্বেগজনক। আর এ বছর স্কোর ও উচ্চক্রম অনুযায়ী অবস্থানের অবনমন হয়ে প্রমাণ করে যে, গত ১৩ বছর কর্তৃত্ববাদী সরকার মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও বাস্তবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালন করেছে, এমনকি দুর্নীতি সংঘটনে সহায়তা ও অংশগ্রহণ করেছে।
রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে গতকাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২৪’ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে বলে তিনি জানান। সিপিআই অনুযায়ী, দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০ (শূন্য) থেকে ১০০ (এক শ’)-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে স্কেলের ০ (শূন্য) স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বোচ্চ এবং ১০০ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন বলে ধারণা করা হয়।
টিআইবি বলছে, গত ১৩ বছর চৌরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সরকার মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও, বাস্তবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালন করেছে, এমনকি দুর্নীতি সংঘটনে সহায়তা ও অংশগ্রহণ করেছে। এর প্রভাবে যথেচ্ছ লুটপাট, দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয়ভাবে তোষণ, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা এবং সার্বিক কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের ক্রমাবনতি হয়েছে। ভঙ্গুর এই কাঠামো ঠিক করে দুর্নীতির রাশ টানা এবং দুর্নীতিবাজদের কঠোর বিচারের জন্য টিআইবি ছয় দফা সুপারিশ প্রদান করেছে ।
জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) বিদায়ী ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ পিছিয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৫১তম। ২০২৩ সালে অবস্থান ছিল ১৪৯তম।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০২৪ সালের সূচকে ৯০ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক। ৮৮ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড ও ৮৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর। আর ৮ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে দক্ষিণ সুদান। ৯ স্কোর পেয়ে নিম্নক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সোমালিয়া এবং ১০ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ভেনিজুয়েলা। সিপিআই-এ অন্তর্ভুক্ত ১৮০টির মধ্যে ৫৭ শতাংশ বা ১০১টি দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর কম স্কোর পেয়েছে। ৬৮ শতাংশ বা ১২২টি দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে। এ বছর সূচকে অন্তর্ভুক্ত এক-চতুর্থাংশ বা ৪৭টি দেশ ২০১২ সাল থেকে গত ১৩ বছরের মধ্যে তাদের সর্বনিম্ন স্কোর পেয়েছে।
সবচেয়ে কম দুর্নীতি ৫ দেশে
সিপিআই অনুযায়ী, ১০০-এর মধ্যে ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ডেনমার্ক। অর্থাৎ ১৯০টি দেশের মধ্যে ডেনমার্কে সবচেয়ে দুর্নীতি কম হয়। তারপর সবচেয়ে কম দুর্নীতি থাকা দেশগুলোর মধ্যে ৮৮ স্কোর নিয়ে ফিনল্যান্ড দ্বিতীয়, ৮৪ স্কোর নিয়ে সিঙ্গাপুর তৃতীয়, ৮৩ স্কোর নিয়ে নিউজিল্যান্ড চতুর্থ এবং ৮১ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড পঞ্চম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয় ভুটানে। ১০০-এর মধ্যে ৭২ স্কোর নিয়ে তাদের অবস্থান ১৮তম। দেশটিতে ২০২৩ সালের তুলনায়ও দুর্নীতি কমেছে। ভুটানের ধারেকাছে নেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই গত বছর দুর্নীতি বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ ৩ পয়েন্ট, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ২ পয়েন্ট এবং বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও মালদ্বীপের স্কোর ১ পয়েন্ট করে অবনতি হয়েছে।
ব্রিফিংয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সূচকের এবারের বিশ্লেষণ মতে বাংলাদেশ এমন সব দেশের পর্যায়ে রয়েছে, যারা দুর্নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা অতি উদ্বেগজনক। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে রয়েছে। ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৫০টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৭, ৩৭ ও ২৯। অন্য দিকে বাংলাদেশের স্কোর ২৩, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও ২০ পয়েন্ট কম।
স্কোর বিবেচনায় গতবারের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্লেষণে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, নাগরিক স্বাধীনতা ও মানব উন্নয়ন সূচকে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা দেশের চেয়েও আমাদের স্কোর কম। এমনকি সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত অঞ্চল, সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশে অর্জিত স্কোর ১০ পয়েন্ট কম। ২০১২ সালের পর এ বছরের স্কোর সর্বনিম্ন। যা উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। আরো লক্ষণীয়, আমাদের দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ এমন সব দেশে যাচ্ছে, যারা সূচক অনুযায়ী ভালো অবস্থানে আছে। দেশে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির দায় আমাদের। অর্থপাচার রোধে ব্যর্থতার দায়ও আমাদের। কিন্তু সার্বিকভাবে সব দায় শুধুই বাংলাদেশের- বাস্তব চিত্র এমন নয়। তিনি বলেন, সূচকে উপরের দিকে থাকা দেশগুলোতে দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতির সুযোগ কম হতে পারে; কিন্তু তাদের আইন প্রয়োগ ও চর্চার ক্ষেত্রে এত ফাঁকফোকর রয়েছে যে সেখানে যথেচ্ছভাবে পাচারকৃত অর্থ লগ্নি করা সম্ভব। ফলে বাস্তবক্ষেত্রে অর্থপাচারের ফলে লাভবান হিসেবে ওই সব দেশ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি বিকাশে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।
উপস্থাপিত সূচকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনকাল পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের সুযোগ নেই উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও, ওই সময়সীমা পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর ২০২৪) দলবাজি, দখলদারি, চাঁদাবাজি ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে অব্যাহত ছিল। তাই বলা যায়, সামান্য হলেও কর্তৃত্ববাদ পতন পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতির প্রতিফলন এখানে রয়েছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিহত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেষ্টা করছে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার। কিন্তু তা অব্যাহত থাকবে কি না নির্ভর করছে মূলত সংস্থাটির সক্ষমতার ওপর। দুদকের প্রতি জনগণের যে প্রত্যাশা আছে, সেই লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করার পাশাপাশি দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের স্কোর পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সহযোগিতা জরুরি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধানের মাধ্যমে পতিত সরকার দুর্নীতি করতে উৎসাহ দিয়েছিল। দুর্নীতিকে সরকারিভাবে যেমন সুরক্ষা ও বিচারহীনতা দেয়া হয়েছিল, তেমনি সামাজিকভাবেও একে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হয়েছিল। এই সংস্কৃতিকে সর্বস্তরে পরিহার করতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হলো কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ববাদী চর্চার পরিবর্তন হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী আমাদের তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতির সংস্কৃতি নির্মূলের যে সুযোগ করে দিয়েছে, তা অবলম্বন করেই এ অবস্থা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা