০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১, ৮ শাবান ১৪৪৬
`

ঠিকাদার নিয়োগ দূরের কথা দরপত্রের কাজই শেষ হয়নি

-

মেট্রোরেল লাইন-১ ও ৫ প্রকল্প
-লাইন দুটোর নির্মাণ খরচ ৯৩ হাজার কোটি টাকার বেশি

যানজট এড়িয়ে রাজধানীবাসীর দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে মেট্রোরেলের চলমান দুটি লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। যদিও লাইন-১ এর কাজ অনেকটাই এগিয়েছে অনুমোদন থেকে গত ৫ বছরে। এই দুটি লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার বেশি। যেখানে এমআরটি লাইন-৬ এর প্রাক্কলিত ব্যয় (দ্বিতীয় সংশোধিত) হয়েছে ৩৩ হাজার ৪১৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সোয়া এক বছরে লাইন-৫ এর অগ্রগতি ৩৮.৯৪ শতাংশ এবং লাইন-১ এর অগ্রগতি ৮৯ শতাংশ। ২০২৮ সালের মধ্যে লাইন-৫ নর্দানের কাজ এবং লাইন-১ এর কাজ ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ করতে চাইছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। অবশ্য দুটি প্রকল্পের কাজ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়। প্রকল্প পরিচালকরা এ বিষয়ে বলেন, ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। ঠিকাদার নিয়োগের কাজ বাকি আছে। সেটা হলেই ফিজিক্যাল ওয়ার্ক শুরু হবে। এখনো অনেক টেন্ডার আহ্বান, ওপেন এবং ওয়ার্ক অর্ডারই দেয়া হয়নি। যদিও ২০১৯ সালের শেষে প্রকল্প দুটি একনেক থেকে অনুমোদন পায়।

ডিএমটিসিএলের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাদের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ। তবে বিভিন্ন প্যাকেজের দরপত্র প্রক্রিয়াতে বেশ সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। প্রতিটি প্যাকেজের কাজে অর্থায়নকারী সংস্থা জাইকার সম্মতিপত্র নিতে সময় লাগছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণেও কাজে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। তবে এখন কাজ পুরোদমে চলছে। ফিজিক্যালে কাজের ঠিকাদার নিয়োগই বাকি। তবে অনুমোদিত সময়ে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে না।

এমআরটি লাইন-১: ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুতগামী, নিরাপদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সময়-সাশ্রয়ী, বিদ্যুৎচালিত, দূরনিয়ন্ত্রিত ও পরিবেশবান্ধব অত্যাধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন প্রকল্পের লক্ষ্য। ফাষ্ট ট্র্যাকের এই প্রকল্পের লাইনের দৈর্ঘ ৩১.২৪১ কিলোমিটার। যেখানে পাতাল লাইন ১৯.৮৭২ কিলোমিটার এবং উড়াল লাইন ১১.৩৬৯ কিলোমিটার। দুটি রুটে বিভক্ত। একটি হলো বিমানবন্দর রুট এবং পূর্বাচল রুট। বিমানবন্দর রুট হবে পাতাল এবং পূর্বাচল রুট উড়াল হিসেবে নির্মিত হবে। বিমানবন্দর রুট হলো, বিমানবন্দর-বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত-নদ্দা-নতুনবাজার-উত্তর বাড্ডা-বাড্ডা-আফতাবনগর-রামপুরা-মালিবাগ-রাজারবাগ এবং কমলাপুর ষ্টেশন। পূর্বাচল রুটের অ্যালাইনমেন্ট, নতুনবাজার-নদ্দা-জোয়ারসাহারা-বোয়ালিয়া-মস্তুল-পূর্বাচল ক্রিকেট স্টেডিয়াম-পূর্বাচল সেন্টার-পূর্বাচলপূর্ব-পূর্বাচল টার্মিনাল-পিতলগঞ্জ ডিপো। এখানে স্টেশনের সংখ্যা মোট ২১টি। যেখানে পাতাল ১২টি এবং উড়াল ৭টি। প্রথমে ৮ কোচবিশিষ্ট ২৫ সেট মেট্রো ট্রেন দিয়ে পরিচালনা শুরু করা হবে। তবে ভবিষ্যতে ৩৬ সেট মেট্রো ট্রেনে উন্নীত করার সুযোগ থাকবে। কোচের যাত্রী পরিবহন সক্ষমতার মধ্যে মাঝের ছয়টি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন এবং ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন। প্রতিটি মেট্রো ট্রেনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৮৮ জন যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা রয়েছে। প্রকল্পটির অনুমোদিত বাস্তবায়ন খরচ হলো ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকার ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং সরকারের নিজস্ব ১৩ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা।

২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির কাজের উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আগামী ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা। তবে প্যাকেজ-১ রায়গঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জ মৌজায় ৩৫.৯০ হেক্টর বা ৮৮.৭১ একর ভূমিতে ডিপোর ভূমি উন্নয়নের জন্য গত ৬ মার্চ ২০২৩ সাল থেকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৮৯ শতাংশ। প্যাকেজ-২ এর আর্থিক প্রস্তাব গত ২ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে উন্মুক্ত করা হয়। গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখ দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের প্রতিবেদন জাইকাকে প্রেরণ করা হয়েছে। প্যাকেজ-৩ দরপত্র গত ২০২৪ সালের ১ জুলাই আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র দাখিলের সর্বশেষ সময় ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্যাকেজ-৪ এর দরপত্রগুলো গত ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর উন্মুুক্ত করা হয়েছে। দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়ন শেষে প্রতিবেদন গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে জাইকা বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। আর প্যাকেজ-৫ এর দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনের উপর গত ২০২৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জাইকা থেকে সম্মতি পাওয়া গেছে। বর্তমানে প্রি-কন্ট্রাস্ট নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া প্যাকেজ-৬ এ দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাব গত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ উন্মুক্ত করা হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের প্রতিবেদন জাইকা বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।

অন্য দিকে, প্যাকেজ-৭ এর দরপত্র ২০২৪ সালের ২ অক্টোবর আহ্বান করা হয়েছে এবং দরপত্র দাখিলের সর্বশেষ সময় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্যাকেজ-৮ এর ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি দরপত্র উন্মুক্তকরণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর প্যাকেজ-৯ এর দরপত্রগুলো ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর উন্মুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে দরপত্রগুলোর কারিগরি মূল্যায়নের কাজ চলমান রয়েছে। প্যাকেজ-১০ এর দরপত্র ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর উন্মুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে দরপত্রগুলোর কারিগরি মূল্যায়নের কাজ চলমান রয়েছে। প্যাকেজ-১১ এর দরপত্র চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র দাখিলের সর্বশেষ তারিখ এ বছরের ২২ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়েছে। প্যাকেজ-১২ এর দরপত্র দলিলে জাইকা প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ অভিযোগ ও সংশোধিত দরপত্র নথি সম্মতির জন্য গত ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর জাইকা বরাবর প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে দরপত্র দলিলের পার্ট-১ ও ২, পার্ট-৩ জাইকার পর্যবেক্ষণ অভিযোগ আবারো সংশোধন করে ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর জাইকা বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। গত ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর জাইকাকে তাগাদাপত্র প্রেরণ করা হয়েছে।

এমআরটি লাইন-৫ (নর্দার্ন): ডিএমটিসিএলের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০২৮ সালের মধ্যে হেমায়েতপুর হতে ভাটারা পর্যন্ত পাতাল ও উড়াল সমন্বয়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইন নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হবে। এই কাজ চলছে ২০১৯ সাল থেকে। হেমায়েতপুর হতে আমিন বাজার পর্যন্ত ও নতুন বাজারের পর হতে ভাটারা পর্যন্ত ৬.৫০ কিলোমিটার উড়াল এবং আমিন বাজার হতে নতুন বাজারের ট্রানজিশন পর্যন্ত ১৩.৫০ কিলোমিটার পাতাল মোট ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৪টি স্টেশন (পাতাল ৯টি ও উড়াল ৫টি) বিশিষ্ট মেট্রোরেল নির্মাণের নিমিত্ত লাইন-৫ এর নির্মাণ কাজ গত ৪ নভেম্বর ২০২৩ শুরু হয়েছে। নির্মাণ কাজ মোট ১০টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তার মধ্যে হেমায়েতপুর ডিপোর ভূমি উন্নয়নসংক্রান্ত প্যাকেজ-০১ এর ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত অগ্রগতি ৩৮.৯৪ শতাংশ। অবশিষ্ট প্যাকেজগুলোর দরপত্র বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন আছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হেমায়েতপুর ডিপোর ভূমি উন্নয়নসংক্রান্ত প্যাকেজ-০১ এর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে গত ২৩ মে ২০২৩ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গত ১৬ জুলাই ২০২৩ নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হেমায়েতপুর ডিপোর ভূমি উন্নয়ন কাজ শুরু করেছে। অন্যান্য প্যাকেজের দরপত্র বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। হেমায়েতপুর হতে ভাটারা পর্যন্ত ১৪টি মেট্রোরেল স্টেশন ও ইস্টার্ন ট্রানজিশন সেকশন নির্মাণের জন্য মোট ১১ দশমিক ১০০১ একর ভূমির অধিগ্রহণের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলছে। তবে ৯৯.২৫ একর জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। ক্রয় কাজের ৯টি প্যাকেজের কাজ চলমান। প্রকল্প ব্যয়ের জাইকা দেবে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি ৫ লাখ টাকা। আর সরকারকে দিতে হবে ১২ হাজার ১২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

লাইন-৫ নর্দান রুটে প্রকল্প পরিচালক মো: আফতাব হোসেন খানের সাথে গতকাল মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, কাজ হয়েছে অনেকই। আমাদের এখন প্রকিউরমেন্ট কাজ চলছে। মানে ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি বলেন, ভৌত বা ফিজিক্যাল কাজ করা হলেই বলা যাবে কতটা হয়েছে। আমাদের মাত্র ভূমি উন্নয়নে একটি প্যাকেজের কাজ চলছে। ওটাই ৩৮.৯৪ শতাংশ। আর বাকি ৯টা প্যাকেজে ঠিকাদার নিয়োগ এখনো হয়নি। প্রকল্প অনুমোদনকালে সরকার যে সময় বেঁধে দিয়েছে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর, সে সময়ের মধ্যে আশা করছি কাজ শেষ হবে।

লাইন-১ এর প্রকল্প পরিচালক মো: আবুল কাসেম ভূঁঞার সাথে গতকাল মোবাইল ফোনে প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা এখনো ওয়ার্ক অর্ডার দেইনি। তিনি বলেন, আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাকেজ পাঁচ বছর মেয়াদি। এখনো একটারও ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, টেন্ডারিংয়ের প্রক্রিয়া চলছে। কোনো কোনোটা শেষের দিকে। আন্ডারগ্রাউন্ড টেন্ডার তিনটা ওপেন করা হয়েছে। বাকিগুলো টেন্ডারিংএ আছে।


আরো সংবাদ



premium cement