০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`
স্লোগানে উত্তাল ভাঙচুর-আগুন

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে ভাঙচুর করে : নয়া দিগন্ত -


রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে গত রাতে ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে ছাত্র-জনতা। এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ৩২ নম্বরের আশপাশের এলাকা।
নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল অধিবেশনকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় ‘বুলডোজার মিছিলের’। ঘোষণা অনুযায়ী রাত ৮টায় কর্মসূচি শুরুর কথা থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে সেখানে জড়ো হতে থাকেন ছাত্র-জনতা। এ সময় তারা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
একপর্যায়ে রাত ৮টার কিছু আগে ৩২ নম্বরের ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ে ছাত্র-জনতা। চালানো হয় ভাঙচুর। ৩২ নম্বরের বাড়িতে প্রবেশের মুখে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালটি ভেঙে ফেলা হয়। রাত ৮টার আগেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ধানমন্ডিতে গিয়ে প্রথমে বাড়িটির ফটক ভেঙে ফেলা হয়। পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করা হয়। রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ভবনের তিনতলার একটি জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে, রাত সাড়ে ৮টার দিকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে বলে খবর আসে। তবে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি বলে জানানো হয়।
ঘটনাস্থলে দেখা যায়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটি ঘিরে শত শত ছাত্র-জনতার উপস্থিতি। স্লোগান চলতে থাকে একের পর এক। ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয় বাড়িটির ভেতরে বিভিন্ন জিনিসপত্র। পুরো বিল্ডিংটির অবকাঠামোই ভেঙে ফেলা হয়। যদিও গত ৫ আগস্ট এক দফা ৩২ নম্বরের এ বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছিল।

বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এ সময় বলেন, যারা ছাত্র হত্যার সাথে জড়িত ছিল সেসব ফ্যাসিবাদীদের কোনো চিহ্ন বাংলাদেশের মাটিতে রাখতে চাই না। অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত এনে তার শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় উত্তেজিত ছাত্র-জনতাকে, ‘খুনি আসলে লাইভে, জনতা যাবে ৩২ এ’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
এর আগে জাতীয় নাগরিক কমিটির ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়, ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল করা হবে। সেখানে বলা হয়, হাজারো ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই খুনি হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার প্রতিবাদে ২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উদ্যোগে রাত ৯টায় এ কর্মসূচি পালিত হবে। পরে কর্মসূচি পরিবর্তন করে রাত ৮টায় নিয়ে আসা হয়। এর আগে টানা ৩৬ দিন কোটা সংস্কারের প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতের উদ্দেশে যাওয়ার খবরের কয়েক ঘণ্টা পর গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। ওই দিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের বেশ কিছু ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়ার পর বিকেল ৪টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। রাত সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জড়ো হচ্ছিল।

ভাঙচুরের একপর্যায়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির তৃতীয় তলায় আগুন দেয়া হয়। ভবনটি গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য রাত পৌনে ১১টার দিকে সেখানে বড় একটি ক্রেন আনা হয়েছে। ৩২ নম্বরের এই বাড়ির পাশের একটি ভবনের এক পাশেও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
৩২ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলা ও দোতলায় অনেক মানুষ দেখা যায়। বাড়িটির দেয়াল ভাঙছেন কেউ কেউ। অনেকে হাতুড়ি বা লাঠি দিয়ে বাড়িটির সীমানা দেয়াল ভাঙছেন। কিছু মানুষকে জানালার গ্রিল, কাঠ এসব নিয়ে যেতে দেখা যায়। অনেক মানুষ বাড়িটির সামনে আসছেন, কিছুক্ষণ দেখে, ছবি তুলে ও ভিডিও করে চলে যাচ্ছেন। বাড়িটির সামনে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী স্বৈরাচারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন। ‘স্বৈরাচারের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ বেশি শোনা গেছে। এর মধ্যে ৩২ নম্বর বাড়ির উল্টো পাশে লেকের সেতুর পাশ দিয়ে খোলা জায়গায় প্রজেক্টরে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। এর আয়োজন করেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, ধানমন্ডি থানা শাখা।
এ দিকে আশপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা ছাত্র-জনতার বাধার মুখে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার বলেন, পুলিশ নজর রাখছে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।

শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙচুর
সিলেট ব্যুরো জানায়, ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ছাত্র-জনতার হামলা ও ভাঙচুরের খবরে সিলেটের রাস্তায় নেমে পড়ে ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী শত শত জনতা রাত সাড়ে ৯টায় এতিহাসিক কিন ব্রিজের সামনে জড়ো হয়ে বুলডোজার নিয়ে মিছিল বের করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই বিরাট মিছিল থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালের অবশিষ্টাংশ ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়।
রাত সাড়ে ৯টায় কিন ব্রিজের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেটের প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিবের নেতৃত্বে শত শত ছাত্র-জনতা বুলডোজার নিয়ে মিছিল শুরু করে। ‘ফ্যাসিবাদের আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘ফ্যাসিবাদের আস্তানা বাংলাদেশে হবে না’ স্লোগানে মুখরিত মিছিল এগিয়ে যায় বন্দর বাজার এলাকায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে। এখানে সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেয়ার সময় সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব বলেন, বাংলাদেশের কোথাও ফ্যাসিবাদের চিহ্ন থাকতে দেয়া হবে না। এ রিপোর্ট লেখার সময় এখনো মিছিল চলছে।
খুলনার শেখ বাড়িও গুঁড়িয়ে দেয়া হলো

খুলনার শেখ বাড়ি হিসেবে খ্যাত পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার চাচাতো ভাইদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। গতকাল রাত ৯টার দিকে নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে ছাত্র-জনতা শেরেবাংলা রোডে অবস্থিত বাড়িটির সামনে এসে জড়ো হতে থাকে। তারা ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেয়। একপর্যায়ে তারা পরিত্যক্ত এই বাড়ির প্রবেশপথে টিন ও বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা অস্থায়ী দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দোতলা বাড়িটিতে লাঠি, রড দিয়ে আঘাত হানতে থাকে। জানা গেছে, রাত সাড়ে ৯টার দিকে একটি এবং তার ১০ মিনিট পরে আরো একটি বুলডোজার সেখানে আনা হয়। তার আগেই ছাত্র-জনতা পরিত্যক্ত বাঁশ, কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় সামনের ব্যস্ততম শেরেবাংলা রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মিনহাজুল আবেদীন সম্পদ বলেন, এই বাড়ি ছিল শেখ হাসিনার দ্বিতীয় কেবলা। খুলনাবাসীকে নির্যাতন করার আখড়া। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটত এখান থেকে। ৪ আগস্ট এই বাড়িটি ছাত্র-জনতা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল; কিন্তু এর কাঠামো দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্যাসিবাদের দোসররা বাড়িটি রক্ষা করতে দুই প্রবেশপথে বাঁশ টিনের বেড়া দিয়েছিল। এই কাঠামোর ওপর ভর করে তারা আবারো বাংলার মাটিতে পুনর্বাসিত হতে চায়। আমরা আর কোনো ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের সুযোগ দেবো না।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ হেলাল, সাবেক এমপি শেখ জুয়েল, বিসিবির সাবেক পরিচালক শেখ সোহেলসহ পাঁচ ভাই এই বাড়িতে প্রায়ই বসবাস করতেন এবং সেখান থেকে রাজনীতি, চাকরিবাকরি, নিয়োগ-বদলি, নির্বাচনে নমিনেশন, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত দুটো বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙার কাজ চলছিল। সেখানে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাউকে দেখা যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement