০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১, ৫ শাবান ১৪৪৬
`

বিনা টেন্ডারে দলীয় অনুগতদের জ্বালানি তেল পরিবহনেও সুযোগ

নসরুল হামিদ বিপুর কারসাজি
-

- কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে বিপিসি
- বয়সসীমায় ফেলে জাপানি ট্যাংকারগুলোর সাথে চুক্তি বাতিল
- বহাল তবিয়তে নিম্নমানের জাহাজ
- হরহামেশাই জনমৃত্যুর ঘটনা ও জ্বালানি তেলের অপচয়
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের অপশাসনের সময়ে জ্বালানি খাতের মহালুটপাটের অন্যতম হাতিয়ার ছিল দায়মুক্তি আইন ও দলীয় অনুগতদের বিনা টেন্ডারে কাজ করার সুযোগ দেয়া। এর মাধ্যমে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন থেকে এ খাতের বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয়ের সর্বনিম্ন দরদাতা নির্ধারণ করা যেত না। ইচ্ছেমাফিক ব্যয় বাড়িয়ে দলীয় অনুগতদের কাজ দেয়া হতো। আর এ অবস্থা থেকে রেহাই পায়নি জ্বালানিতেল পরিবহনের কাজে জাপান নির্মিত জাহাজগুলোও। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মতো জাপানের নির্মিত জাহাজগুলোকে বয়সের সীমায় ফেলে বাদ দেয়া হয়। বিপরীতে দলীয় অনুগতদের দিয়ে বিনা টেন্ডারে নিম্নমানের জাহাজে জ্বালানিতেল পরিবহনের সুযোগ করে দেয়া হয়। আর এর মাস্টার মাইন্ড ছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। প্রতিমন্ত্রীর এ স্বেচ্ছাচারিতায় এক দিকে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়, পাশাপাশি জাহাজগুলো হরহামেশাই দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে জনমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। একই সাথে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চল্লিশ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো জাহাজে জ্বালানিতেল পরিবহন করা যাবে না এমন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, যা ছিল সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত ও একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত। কারণ জাহাজ চলাচল ও নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হচ্ছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও নৌ বাণিজ্য অধিদফতর। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় ২৫ বছরের পুরনো জাহাজ আমদানির অনুমোদন ছিল। আবার জাহাজটি যে আইনে চলাচল করবে সে আইনে কোনো বয়সসীমা নেই। শুধু জাহাজটি চলাচলের সক্ষমতার বিষয়ে সার্ভেয়ার যে সনদ দেবে তার ওপর ভিত্তি করে জাহাজটি চলাচল করবে। সার্ভেয়ার নেতিবাচক সনদ দিলে সংশ্লিষ্ট জাহাজ আর চলতে পারবে না। এ নির্দেশনা অনুযায়ী জাপান থেকে জাহাজ আমদানি করা হয়েছিল। এ জাহাজগুলো গুণগত মানে যেমন উন্নত ও টেকসই ছিল, তেমনি দুর্ঘটনারও কোনো নজির নেই, এমন প্রতিবেদন উঠে এসেছে বিপপিসির এক প্রতিবেদনে। এ জাহাজগুলো অত্যন্ত সুনামের সাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসির আওতাধীন পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার জ্বালানিতেল পরিবহন করে আসছিল; কিন্তু ২০১০ সালে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু তার অনুগত ও দলীয় অনুসারীদের প্রতিষ্ঠিত করতে ৪০ বছরের বয়সসীমায় ফেলে জাপানি জাহাজগুলোর তেল পরিবহনে চুক্তি নবায়ন বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে জাহাজ চলাচল ও নিয়ন্ত্রণে একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকেও অবমাননা করা হয়। কারণ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে এ নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, ৪০ বছরের ঊর্ধ্বের জাহাজগুলো ২০২৭ সাল পর্যন্ত জ্বালানিতেল পরিবহন করতে পারবে। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন এ খাতের অভিজ্ঞ উদ্যোক্তারা।
যেভাবে বাদ দেয়া হয় : ২০০৯ সালে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলীয়করণ করতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে বিনা টেন্ডারে কুইক রেন্টাল ও পরবর্তী সময়ে অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়। উচ্চ মূল্যের এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানিতেল পরিবহনের ক্ষেত্রেও দলীয় ও অনুগতদের প্রাধান্য দেয়ার পাঁয়তারা শুরু করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ২০১০ সালে দলীয় ও অনুগতদের জ্বালানিতেল পরিবহনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুমোদন (এলওআই) দেয়া হয়। তখন বলা হয়, কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানিতেল পরিবহনের জন্য জাহাজ দরকার হবে। আর এ জন্য দলীয় লোকদের জাহাজ নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। সাধারণত দুই ধরনের জাহাজ রয়েছে। একটি হলো মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিনেন্স ১৯৮৩ অনুযায়ী নিবন্ধিত কোস্টাল জাহাজ, যেটা চট্টগ্রাম বন্দরসহ সারা দেশেই নৌপথে চলাচল করতে পারবে। আর দ্বিতীয়টি হলো ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিনেন্স ১৯৭৬ অনুযায়ী নিবন্ধিত বে-ক্রসিং শ্যালো, যা চট্টগ্রাম বাদে অগভীর নৌরুটে চলাচল করতে পারবে এমন জাহাজ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী শ্যালো জাহাজ বছরে মাত্র তিন মাস অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করতে পারবে। প্রথমে দলীয় অনুগত নেতাকর্মীদের জ্বালানিতেল পরিবহনে অন্তর্ভুক্ত করতে ২০১০ সালে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের এক বৈঠকে ৪০ বছরের পুরনো জাহাজে জ্বালানিতেল পরিবহনে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। একই সাথে এলওআই অন্তর্ভুক্ত জাহাজগুলোর জ্বালানিতেল পরিবহনে ওই সময়ে চলমান জাহাজগুলোর চেয়ে কোস্টাল জাহাজের ক্ষেত্রে ৫২ পয়সা এবং শ্যালো জাহাজের ক্ষেত্রে ৭২ পয়সা কম মূল্যে নির্ধারণ করা হয়। লোক দেখানো এ সিদ্ধান্ত বেশি দিন বহাল ছিল না। দলীয় নেতাকর্মীদের জাহাজ যখন জ্বালানিতেল পরিবহন শুরু করে তখন তা সমতায় আনা হয়। ২০১৬ সালে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে পুরনো জাহাজগুলোর যে ভাড়া, নতুন করে এলওআই অন্তর্ভুক্ত জাহাজগুলোর ভাড়াও একই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এক দিকে দলীয় অনুগতদের নির্মিত জাহাজগুলো আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে পণ্য পরিবহন করতে থাকে। বিশেষ করে শ্যালো জাহাজগুলো সারা বছরই পণ্য জ্বালারিতেল পরিবহন করতে থাকে। এতে সময়ে সময়ে দুর্ঘঢনায় পতিত হয় অনেক জাহাজ। বিপিসির এক প্রতিবেদনেও এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়। বিপিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে জাহজগুলোর দ্বিপক্ষীয় নবায়ন বন্ধ থাকায় গুণগত মানের জাহাজ কমে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো জাহাজ বাদ পড়বে। চলমান কোম্পানির পরিবহনবহরে মোট ১৬২টি ট্যাংকার রয়েছে। এর মধ্যে ১৪৩টি ট্যাংকার দেশে নির্মিত। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অনুমোদিত (এলওআইভুক্ত) এসব জাহাজগুলো গুণগত মানে ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত। এ কারণে এ ট্যাংকারগুলোর দুর্ঘটনার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনটি ট্যাংকারের অগ্নিদুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণের কারণে জনমৃত্যু ঘটনার পাশাপাশি জ্বালানিতেলের অপচয় হয়েছে। অথচ জাপানি ট্যাংকারগুলোর দুর্ঘটনার কোনো নজির ছিল না বলে বিপিসি স্বীকার করেছে। অপর দিকে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসিও বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কারণ, নির্মাণ ত্রুটিপূর্ণ জাহাজগুলোর তেল পরিবহনে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ায় জ্বালানিতেল বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকার বাড়তি অর্থ গুনতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসররুল হামিদ বিপুর অনুগত ও দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। আর এ জন্যই বিনা টেন্ডারে জ্বালানিতেল পরিবহনে দলীয় অনুগতদের অনুমোদন দেয়া হয়। পুরনো জাহাজের কথা বলে কৌশলে এ খাতে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের বাদ দেয়া হয়। এতে তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। তারা জানিয়েছেন, বিপণন কোম্পানিগুলোর সাথে ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে জাহাজের চুক্তি বাতিলসংক্রান্ত নসরুল হামিদের একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। একই সাথে ২০১৬ সালের পর জ্বালানিতেল বিপণন কোম্পানিগুলো যে জাহাজগুলোর সাথে চুক্তি বাতিল করেছিল তা পুনরায় নবায়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement