০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১, ৫ শাবান ১৪৪৬
`

সব ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট, নিয়ে গেছে ‘সুসুকের’ ৩ হাজার কোটি টাকাও

সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা
-

পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, টাকা তো নেই ব্যাংকের কাছে। কারণ কোথাও কোনো অর্থ নেই। সব ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে গেছে। বিশ্বের কোনো দেশে এমন হয়েছে বলে আমার জনা নেই। ব্যাংকের ডিপোজিটের টাকাসহ চলে গেছে। সুসুক বন্ডের (ইসলামী বন্ড) তিন হাজার কোটি টাকাও তারা নিয়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে এতে আমাদের কতটা যে চাপ পড়ছে সেটা বাইরে থেকে জানার কথা না। সেটা ব্যাংকার ও আমি জানি তবে সেটা কোনো খারাপ অবস্থা না। যদি আমরা কাউন্টার ইস্যুগুলো না নিতাম তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা একটা অকল্পনীয় অবস্থায় চলে যেত। সেই টাকাগুলো আমরা দিচ্ছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে কথা বলেছি যে কিভাবে বিশেষ ফান্ড করে দেয়া যায়। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে দেশে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকেই শ্রীলঙ্কার সাথে তুলনা করেন। শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ এক না। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বাংলাদেশের মতো এত খারাপ অবস্থায় যায়নি। বাংলাদেশের মতো হলেতো শ্রীলঙ্কাকে আর খুঁজেই পেতাম না।
তাহলে কি বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার থেকেও খারাপ এমন প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, যখন আমরা দায়িত্ব নিলাম তখন ৬০ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১২টা ভালো অবস্থায় ছিল। আর বাকিগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। এ রকম কোনো দেশে হয়েছে কি?
তিনি আরো বলেন, টকশোতে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দেয়, মূল্যস্ফীতি কমে গিয়েছিল, এতটুক একটা দেশ। তাদের পলিসি হলো যেই সরকারই আসুক তাদের একটা চুক্তি থাকে তাকে সাপোর্ট করতে হবে। আর আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো দুই থেকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের মূল্যস্ফীতির দিকে মূল মনোযোগ আছে। যতটুকু সম্ভব যত তাড়াতাড়ি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি। এখন আমরা যে উদ্যোগটা নেবো সেটার প্রভাব বাজারে দেখতে পারবেন। আশা করছি, জুন মাসের দিকে মুল্যস্ফীতিতে একটা আইডল ৬-৭ শতাংশে যেতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য বেটার হয়।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, যেকোনো ইনডেক্স যখন উঠতে থাকে তখন অপ্রয়োজনীয় কোনো দুর্যোগ না থাকলে, যেমন শেয়ারবাজার উঠেছে, কিন্তু চুরিদারির পর আবার নিচে নেমে গেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির বিষয়টা একটু অন্য রকম। এখানে কতগুলো কারণ আছে। যেমন টাকার সরবরাহ বেশি ছিল, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। কোনো জিনিস উঠে গেছে জোর করত নামানো যায় না। এটাতো শুধু অর্থনৈতিক বিষয় না, সাপ্লাই চেইন, মনিটারি পলিসি, আর সরবরাহ ছাড়াও কতগুলো কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও রোজার এ সময় একটা ক্রাইসিস থাকে। আর এ সময়ের জন্য বড় ধরনের একটা উদ্যোগ নেই। সেটার ফলটা এপ্রিল-মে’র দিকে গিয়ে পড়ে। এ জন্য এপ্রিল, মে পর্যন্ত কোনো নিত্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি হতে দেবো না। সে জন্য আজকে চাল, ডাল, সারসহ অত্যাবশকীয় কতগুলো পণ্যের আমদানির অনুমোদন দিয়েছি।
তিনি বলেন, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে আমরা যে উদ্যোগটা নেবো সেটার প্রভাব বাজারে দেখতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও মুদ্রানীতি দেবে।
ভ্যাট নিয়ে এক প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে ভ্যাট ইস্যুর জন্য দাম বেড়েছে যেমন বিস্কুট। যাই হোক এসব নিয়ে আমরা পরশুদিন (৬ জানুয়ারি) ব্যবসায়ীদের সাথে বসব। মার্চের দিকে বাজেট পুনঃ মূল্যায়ন করব। সেখানে নির্দিষ্ট কিছু অ্যাকশন দেখবেন। বিশেষ করে অর্থনৈতিক খাতে। মেইন উদ্দেশ্য হচ্ছে ভ্যাটের। দিনের পর দিন ছাড় দেয়া হয়েছে। এগুলোকে আমি আর উৎসাহ দেবো না। এর মধ্যে হয়তো দুই-একটা পণ্যে প্রভাব পড়েছে। এতে লোকজনের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে, সেটা লাঘবে আমি চেষ্টা করব। আয়করের বিষয় আছে সেটা দেখব, যাতে অন্য ট্যাক্স তাদের কম হয়।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা ক্রয় কমিটিতে চাল, মসুর ডাল কেনার অনুমোদন অনবরত দিয়ে যাচ্ছি। এতে আমাদের কিন্তু ফরেন এক্সচেঞ্জে বিরাট চাপ পড়ছে তারপরও দিচ্ছি। গতকাল গভর্নর ব্যাংকারদের সাথে বসেছিলেন, সেখানে তাদের বলেছি যেভাবেই হোক আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জে সাশ্রয় করতে হবে। তবে অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ আমরা কোনোদিনই কমতে দেবো না। এর মধ্যে চাল, মসুর ডাল, ভোজ্যতেল সয়াবিন, এলএনজি এবং সারের সরবরাহ রয়েছে।
তিনি বলেন, গতকাল (সোমবার) আমি সারাদিন ব্যাংকারদের সাথে বৈঠক করেছি। কিভাবে ট্রেডফ্লো বাড়ানো যায় বেসরকারি খাতে, কিভাবে আরো সাশ্রয়ী করা যায় ব্যবসায়। আমরা চেষ্টা করছি ব্যবসাটা রান করার জন্য।
সামনে রমজান মাস, এর মধ্যে ফল ব্যবসায়ীরা ভ্যাট-ট্যাক্স না কমালে আমদানি ও খালাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন সাংবাদিকরা এমন প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সেটা তাদের বিষয়। এ বিষয়ে আমার আর কোনো অ্যাকশন নেয়ার নেই। রমজান মাসে দেখা যাবে ফল আমদানির কী পরিস্থিতি। আমরা খেজুর আমদানি করছি, বহু আগেই খেজুর আমদানিতে শুল্ক তুলে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি জানিয়ে বিনিয়োগকারীরা গতকাল সমাবেশ করেছেন- এ বিষয়ে তিনি বলেন, সেগুলো তারা বলুক, তারা একেকজন নানা কথা বলবে, যার যার অবস্থান থেকে। যারা লোকসান দেবে তাদের প্রতি সমবেদনা থাকবে। আর এটাতো নতুন চেয়ারম্যানের কাণ্ড না। আগে যারা ছিল তারা এ কাণ্ড করেছে। তারা যেভাবে টাকা নিয়েছে সুকুকের তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। আমরা এসব বিষয় সমাধানের চেষ্টা করব।
২,৩৯৮ কোটি টাকার ১২ ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন
এ দিকে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানি শোধনাগার স্থাপনসহ ১২টি ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’। এতে মোট ব্যয় হবে ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ক্রয় কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
বৈঠক শেষে জানানো হয়, সভায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানি শোধনাগার ও গভীর নলকূপ স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১ নং ৫০ এমএলডি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনে ঠিকাদার নিয়োগের একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যৌথভাবে এ কাজ করবে। জেডএইচইসি-বিওডব্লিউ-এসএমইডিআরআইসি। এতে ব্যয় হবে ৫১৮ কোটি ৬১ লাখ ২১ হাজার টাকা।
বৈঠক সূত্র জানায়, সভায় রাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) জন্য সৌদি আরবের মা’এডেন থেকে দ্বিতীয় লটে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সার এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) জন্য একই দেশের সাবিক অ্যাগ্রি-নিউট্রিয়েন্টস কোম্পানি থেকে ১৬তম লটে ৩০ হাজার মেট্রিক টন বাল্ক গ্র্যানুলার (অপশনাল) ইউরিয়া সার আমদানির দু’টি পৃথক প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি মেট্রিক টন ৬১১ ডলার দরে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সার আমদানিতে বাংলাদেশী মুদ্রায় ব্যয় হবে ২৯৮ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
অন্য দিকে প্রতি মেট্রিক টন ৩৯৫.১৬ ডলার দরে ৩০ হাজার মেট্রিক টন বাল্ক গ্র্যানুলার (অপশনাল) ইউরিয়া সার আমদানিতে বাংলাদেশী মুদ্রায় ব্যয় হবে ১৪৪ কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
এ ছাড়া কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে ১২তম লটে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ব্যাগড গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কেনার পৃথক আরেকটি প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রতি মেট্রিক টন ৩৮৯.৭৫ ডলার দরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এতে ব্যয় হবে ১৪২ কোটি ৬৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
জানা গেছে, সভায় আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ডিএপিএফসিএলের জন্য ২০ হাজার মেট্রিক টন করে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ফসফরিক এসিড (পি২ও৫: ৫২-৫৪%) আমদানির দুটি পৃথক প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দু’টি প্রস্তাবেই ফসফরিক এসিড সরবরাহের কাজটি পেয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সান ইন্টারন্যাশনাল এফজেডই। এসিড প্রস্ততকারক মূল কোম্পানি হচ্ছে চীনের গুইয়ানজি পেংগুয়ি ইকো-টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড ও দক্ষিণ আফ্রিকার ফস্কর পিটিওয়াই লিমিটেড। এর মধ্যে প্রথম প্রস্তাবে প্রতি মেট্রিক টন ৬৩৩.৪২ ডলার দরে ২০ হাজার মেট্রিক টন ফসফরিক এসিড আমদানিতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫২ কোটি ২ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রতি মেট্রিক টন ৬১৭.৭৬ ডলার দরে ২০ হাজার মেট্রিক টন ফসফরিক এসিড আমদানিতে বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৫০ কোটি ৭৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ব্যয় হবে।
বৈঠকে সেতুর পূর্ত কাজ সম্পাদনে দু’টি পৃথক প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এলজিইডি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৫ নং গুদারাঘাটের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর কদমরসুল ব্রিজ নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পের ডব্লিউপি-১ প্যাকেজের পূর্ত কাজ সম্পাদনে ব্যয় হবে ৩৯৪ কোটি ৭৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। যৌথভাবে এ কাজটি করবে- জিবিসি ও জিএসডিসি।
একই সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পের ডব্লিউ-১০ প্যাকেজের পূর্ত কাজ সম্পাদনে ব্যয় হবে ১১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ কাজটি করবে যৌথভাবে মো: মইনুদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, মেসার্স হামিম ইন্টারন্যাশনাল ও মো. রাশাদুজ্জামান পিটার।
অন্যদের মধ্যে বৈঠকে ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়) (প্রথম সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের দু’টি পৃথক প্যাকেজের পূর্ত কাজ সম্পাদনে দু’টি পৃথক প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দু’টি কাজই পেয়েছে এম জামাল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। এর মধ্যে প্যাকেজ-৬ এর পূর্ত কাজ সম্পাদনে ১২৭ কোটি ৯৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং প্যাকেজ-৭ এর পূর্ত কাজ সম্পাদনে ১২৫ কোটি ৬৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় হবে।
এ ছাড়া বৈঠকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জন্য স্থানীয়ভাবে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ১০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল ক্রয়ের একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটি সরবরাহ করবে নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড। প্রতি কেজি ৯৭ টাকা ৯২ পয়সা দরে এতে ব্যয় হবে ৯৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা।


আরো সংবাদ



premium cement