০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০ মাঘ ১৪৩১, ৩ শাবান ১৪৪৬
`

আ’লীগ আমলের ৩০০ কোটি টাকার কাজ বাতিল হচ্ছে

বিমান মন্ত্রণালয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব
-


দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চিহ্নিত ঠিকাদাররা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবেই প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছেন। প্রকল্পের কাজ শেষ করার মতো অর্থ নেই, তারপরও নেয়া হয়েছে বড় বড় প্রকল্প। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পাল্টে যাচ্ছে সব কিছু। এখন ওই সব প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অনেকেই কাজ ফেলে গা ঢাকা দিয়েছেন। কেউ আবার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এসব প্রকল্প নির্মাণসংক্রান্ত কাজে অর্থ ব্যয়েও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ বাতিলের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ইতোমধ্যে সংস্থাটির নতুন যোগদান করা চেয়ারম্যান এসব প্রকল্প বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন।
গতকাল রোববার দুপুরের পর বেবিচকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করা প্রসঙ্গে যুক্তি দেখিয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখতে পেয়েছি বিগত সরকারের আমলে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয়। বর্তমান বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ মঞ্জুর কবীর অত্র সংস্থায় যোগদান করার পর এসব প্রজেক্ট বন্ধের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পাশাপাশি ৭টি মসজিদ থাকার পরও মসজিদ নির্মাণ করার কাজ নেয়া হয়েছে, যার কোনো দরকারই ছিল না। বেবিচককে আরো গতিশীল করা, রাজস্ব বাড়ানো এবং সার্বিক কার্যক্রম চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করছেন বর্তমান চেয়ারম্যান। অথচ ঠিকাদার সিন্ডিকেট নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান যে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল রয়েছেন। তিনি কোনোভাবেই আগের সরকারের মতো বিনা কাজে একটি টাকাও অপচয় করতে রাজি নন। এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে দফতরের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন।

অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার আমলে যেসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয়। কোনো কোনো প্রকল্প নেয়া হয়েছিল গায়ের জোরে। ওই প্রকল্পগুলোই বাতিলের পদক্ষেপ নিয়েছে বেবিচক এবং মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কেন্দ্রিক মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিমানবন্দরের স্থাপনা নির্মাণ অন্যতম। সিভিল এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব উন্নয়নমূলক কাজের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাধ্যবাধকতা, ডিপিডি না মানা, ফিজিবিলিটি স্টাডি না হওয়া এবং বিমানসংক্রান্ত কাজগপত্র জমা না দেয়া প্রকল্পগুলোই বাতিলের তালিকায় রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অন্যতম হচ্ছে, কুর্মিটোলার ঈর্শ্বাল কলোনীতে ১৪ তলা ভবন নির্মাণ, কাওলায় ১৪ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ, থার্ড টার্মিনালের দক্ষিণ পাশে স্টেকহোল্ডারদের জন্য অফিস ভবন নির্মাণ, সিএটিসি কমপ্লেক্সে নতুন মসজিদ নির্মাণ, বেবিচক হেড অফিসের পূর্বপাশে ৬ তলা অফিস ভবন নির্মাণ, বেবিচকের প্রশাসনিক এলাকায় সেমসুর অফিস কমপ্লেক্স, ওয়ার্কশপ ও ওয়্যারহাউজ নির্মাণ, তেজগাঁওয়ে দুটি ৬ তলা ভবন নির্মাণ, আমবাগানে নতুন মসজিদ নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৬ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে সেন্ট্রাল স্টোর ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে ডি টাইপ কোয়ার্টার নির্মাণসহ অন্যান্য প্রকল্পের কাজ রয়েছে।
গতকাল রাত ৭টার দিকে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ মঞ্জুর কবীরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরিন জাহানের সাথে যোগাযোগ করা হয়। সিভিল এভিয়েশন থেকে ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ বাতিল করা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা তার মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রথমে তিনি বলেন, এই বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। এরপর তিনি বলেন, প্রস্তাবনা এলে নির্দেশনা যাবে। তবে এই মুহূর্তে আমি মিটিংয়ে আছি। কী নির্দেশনা গেছে তা না দেখে আমি বলতে পারছি না।

সূত্র জানায়, গত ১৬ জানুয়ারি বেবিচক চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত চিঠি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দাফতরিক, আবাসিক, মসজিদ, কলেজ একাডেমিক ভবন নির্মাণসংক্রান্ত কাজ বাস্তবায়নের বিষয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের কাছে নির্দেশনা চাওয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২০২৪ আর্থিক সালে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত ১০টি কাজ (ইএম-আংশিক পূর্ত কাজ ব্যতীত) হাতে নেয়া হয়। সিএএবির বর্ধিত জনবলের দাফতরিক আবাসন, ধর্মীয় উপাসনালয়, শিক্ষালয় প্রভৃতি সুবিধাদি সৃষ্টির প্রয়োজনে এসব কাজ বাস্তবায়ন করার প্রয়োজনীয়তা থাকায় তাদের কাজ ব্যতীত আংশিক পূর্ত কাজের দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে অর্থাৎ ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক জারিকৃত পত্র গত ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বরের আলোকে এই কাজগুলোর ক্রয় প্রস্তাব সিভিল এভিয়েশন অথরিটি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল। কাজগুলো নিজস্ব তহবিলের অর্থ দিয়ে করা হবে। তবে নানাবিধ জটিলতা ও আংশিক কাজের কারণে কাজগুলো বাস্তবায়ন এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালের ৭ মার্চ বেবিচকের নিজস্ব উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ডিপিপি প্রদান অনুমোদন করার পর কাজ বাস্তবায়নের জন্য সিএএবিকে নির্দশনা প্রদান করা হয়েছিল। পরে গত বছরের ৮ জুলাই অপর এক চিঠিতে বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন কাজগুলো ডিপিপি প্রণয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য আবারো নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে তালিকায় বর্ণিত কাজগুলোর জন্য কোনো ডিপিপি প্রণয়ন অনুমোদিত হয়নি বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
সেখানে আরো বলা হয়, পরিচালন বাজেটের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ব্যতীত নতুন আবাসিক, অনাবাসিক ভবন এবং অন্যান্য ভবন স্থাপনা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে চলমান নির্মাণ কাজ ন্যূনতম ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হলে অর্থ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। ফলে চলতি অর্থবছরে ভবন নির্মাণসংক্রান্ত কাজের অর্থ ব্যয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিধি-নিষেধ রয়েছে। ফলে কাজ বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বেবিচক মনে করছে। এ ছাড়া ঠিকাচুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঠিকাদার কর্তৃক কাজ শুরুর আগে বাংলাদেশ সাধারণ বীমা করপোরেশন থেকে ইন্স্যুরেন্স ডকুমেন্টস বেবিচকের কাছে জমা দেয়ার কথা থাকলেও তালিকায় বর্ণিত কাজগুলোর ইন্স্যুরেন্স ডকুমেন্টস অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement