০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০ মাঘ ১৪৩১, ৩ শাবান ১৪৪৬
`

সিলেটে ভারতের বাধায় চালু করা যাচ্ছে না শতকোটি টাকার পাম্প হাউজ

দুই লক্ষাধিক কৃষকের হাহাকার
সিলেটের জকিগঞ্জে নির্মিত রহিমপুর পাম্প হাউজ : নয়া দিগন্ত -


সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাধায় ১০ বছরেও চালু করা সম্ভব হয়নি শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘রহিমপুর পাম্প হাউজ’। জকিগঞ্জসহ পাঁচ উপজেলার লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে অধিক পরিমাণ ফসল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ‘আপার সুরমা কুশিয়ারা’ প্রকল্পের আওতায় এই পাম্প হাউজ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
এই জনগুরুত্বপূর্ণ পাম্প হাউজ চালু না হওয়ায় বিগত ১৬ বছরে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সিলেটের পাঁচ উপজেলার দুই লক্ষাধিক কৃষক। সেচের অভাবে এসব উপজেলার লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় বছরে কমপক্ষে কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন এই অঞ্চলের কৃষকেরা।
পাম্প হাউজ নির্মাণের সুবিধার্থে ২০১০ সালে রহিমপুরী খালের মুখে একটি ক্রস বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো এখন এতদাঞ্চলের মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুফল লাভের আশায় পাম্প হাউজ নির্মিত হলেও এটা চালু না হওয়ায় রহিমপুরী খাল দিয়ে পানি প্রবাহের পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লক্ষাধিক কৃষকের জীবনে এখন হাহাকার দেখা দিয়েছে। কৃষকরা চাষের জমিতে পানি সেচ দিতে না পেরে প্রতি বছর মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এ নিয়ে সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জসহ এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে।
সরেজমিন জকিগঞ্জ ঘুরে জানা গেছে, জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর উৎসমুখ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শরীফগঞ্জ বাজারের পাশেই কুশিয়ারা নদী থেকে রহিমপুর খালটির উৎপত্তি। প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাকৃতিক খালটি আরো অনেক খালের উৎপত্তিস্থল। কুশিয়ারা নদী থেকে এই খাল দিয়ে প্রবাহিত পানি কয়েক শতাব্দী ধরে জকিগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি ও হাওরাঞ্চল ছাড়াও কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার কিছু অংশের পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস ছিল।

উৎসমুখে কুশিয়ারা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় গত কয়েক যুগ ধরে রহিমপুর খালে শুকনো মৌসুমে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এ কারণে অন্তত এক লাখ হেক্টর জমিতে রবিশস্য ও আরো বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে বোরো চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছিল। তাই শুকনো মৌসুমে অনাবাদি থাকা জমিকে চাষযোগ্য করার লক্ষ্যে ‘আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের’ অধীনে ২০১০ সাল থেকে রহিমপুর খালের উৎসমুখে একটি পাম্প হাউজ নির্মাণ ও রহিমপুরসহ এই চেইনের বেশ কিছু খালের উন্নয়ন কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রকল্পের সুবিধার্থে ২০১০ সালে কুশিয়ারা নদীর পারে খালের উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে খাল উন্নয়ন ও পাম্প হাউজের নির্মাণকাজ শেষ করে পাউবো। পরবর্তীতে খালখনন ছাড়াও বাঁধ রক্ষায় ব্লক ফেলাসহ সার্বিক কাজে ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকারও কিছু বেশি । শত কোটি টাকা ব্যয়ে পাম্প হাউজ নির্মাণ শেষে রহিমপুর খালে আবার পানি প্রবাহ চালু করতে উৎসমুখে নির্মিত ‘ক্রস বাঁধ’ অপসারণ করতে গেলে বাধা দেয় ভারত। কুশিয়ারা নদীর ঠিক মধ্যস্রোতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা রয়েছে। এ কারণে এ নদীর বাংলাদেশের পার নো ম্যানস ল্যান্ডের অংশ হওয়ায় ভারতের বাধার মুখে পড়ে বাঁধ অপসারণ কাজ।
আমলসীদ গ্রামের কৃষক আবদুল কাইয়ুম সিদ্দিকী, সাদিকুর রহমান ও রহিমপুর গ্রামের কৃষক জিয়াউর রহমান নয়া দিগন্তকে জানান, আগে রহিমপুর খাল তেমন নাব্য না হলেও পানি কিছুটা আসত। খালে আসা পানি দিয়ে অল্পবিস্তর কৃষিকাজ চলতো। খাল খনন ও পাম্প হাউজ নির্মাণকাজের সুবিধায় ২০১০ সালে রহিমপুর খালের মুখে ক্রস বাঁধ নির্মাণের পর পানি আসার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এলাকার লোক। বিগত ১৬ বছর থেকে রহিমপুর খালের মুখে বাঁধ দেয়ায় খালে পানি না থাকায় ওই এলাকায় জমিতে সেচ দিতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
পানির প্রবেশমুখ বন্ধ করার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, “রহিমপুর পাম্প হাউজটা তৈরি করার জন্য খালের মুখে একটা ক্রস ড্যাম দেয়া হয়েছে, যাতে বন্যার পানি উঠে পাম্প হাউজ নির্মাণকাজকে ব্যাহত না করে। কিন্তু পাম্প হাউজ তৈরি করার পর যখন ক্রস বাঁধটা উঠানোর চেষ্টা হয়েছিল, তখন বিএসএফ বলে বসল, এটা নো ম্যান্স ল্যান্ডের মধ্যে হয়েছে এটা উঠানো যাবে না।”

সচেতন মহলের মতে, চুক্তির মাধ্যমে পানি আনা সম্ভব হলে শুষ্ক মৌসুমে কয়েক হাজার হেক্টর জমির কৃষকরা উপকৃত হবেন। কৃষকরা বর্তমানে কেবল আমন উৎপাদন করেন, চুক্তি অনুযায়ী বাঁধ খুলে দিলে দিলে বোরোসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। খালে খালে পানি যাবে, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানিবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। ফলে পাঁচটি উপজেলার মানুষ উপকৃত হবেন।
খালের মুখে বাঁধ দেয়ার বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে জকিগঞ্জের ৭ নম্বর বারঠাকুরী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মহসিন মর্তুজা চৌধুরী বলেন, রহিমপুর পাম্প হাউজ চালু না হওয়ায় এলাকার কৃষকরা সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিএসএফের বাধায় বাঁধ তোলা যাচ্ছে না এই অজুহাতে বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি রহিমপুরী খালের মুখে দেয়া বাঁধ দ্রুত অপসারণ করে পাম্প হাউস চালুর বিষয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জকিগঞ্জের উপসহকারী প্রকৌশলী মো: মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা সই হলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাধায় এখনো বাঁধ অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে পাম্প হাউজ ও খালের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। দ্রুত সকল আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করে বাঁধ অপসারণ ও পাম্প হাউজ চালু করতে পারলে এলাকাবাসী উপকৃত হবেন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জকিগঞ্জ ব্যাটালিয়নের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বিষয়টি পাউবোর। তাদেরকেই এটা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বিজিবির এখানে কোনো ভূমিকা নেই।

 


আরো সংবাদ



premium cement