অ্যাটর্নি সার্ভিস ও স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব
- হাবিবুর রহমান
- ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:২৭
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্ত
- অ্যাটর্নি সার্ভিসে কর্মরতরা মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্বে থাকবেন
- পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব
- বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধানগুলোর সংশোধনীর প্রস্তাব
- বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা
রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্থায়ীভাবে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন বলে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন মনে করে। এরূপ অ্যাটর্নি সার্ভিসের উদাহরণ প্রতিবেশী দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর অধীনে প্রচলিত তদন্ত ব্যবস্থা এবং তাতে নিয়োজিত জনবলকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত প্রক্রিয়ার যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে। গত ১৮ জানুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ে কমিশনের যে সামারি প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে তাতে এ প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশনের সদস্য তানিম হোসেইন শাওন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে- অ্যাটর্নি সার্ভিস হবে একটি স্থায়ী পেনশনযোগ্য সরকারি চাকরি। অ্যাটর্নি সার্ভিস ও কার্যপদ্ধতিসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি সুনির্দিষ্টকরণের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং এ বিষয়ে সংবিধানে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করতে হবে।
সার্ভিসের জন্য সুনির্দিষ্ট কাঠামো, নিয়োগ পদ্ধতি, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা, বেতন কাঠামোসহ আর্থিক সুবিধাদি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে যথাযথ বিধান সম্বলিত আইন থাকবে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো, বাজেট বরাদ্দ ও সহায়ক জনবলের ব্যবস্থা থাকবে।
প্রস্তাবিত সার্ভিসের দু’টি ইউনিট থাকবে : সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট ইউনিট এবং সহকারী জেলা অ্যাটর্নি, সিনিয়র সহকারী জেলা অ্যাটর্নি, যুগ্ম জেলা অ্যাটর্নি, অতিরিক্ত জেলা অ্যাটর্নি এবং জেলা অ্যাটর্নি সমন্বয়ে গঠিত জেলা ইউনিট।
চাকরির শর্ত অনুযায়ী জেলা ইউনিটের কর্মকর্তাদের আন্তঃজেলা বদলি, জেলা ইউনিট থেকে সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটে বদলি ও পদোন্নতির সুযোগ থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট ইউনিট থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলদের হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগ করা যাবে।
অ্যাটর্নি সার্ভিসের প্রশাসনিক, আর্থিক, অবকাঠামো এবং সহায়ক জনবলসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের একটি পৃথক ইউনিটের উপর।
জেলা অ্যাটর্নি সার্ভিসে কর্মরত সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটর প্রতিটি তদন্তযোগ্য মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্বে থাকবেন। প্রসিকিউটর কর্তৃক তদন্ত তত্ত্বাবধান বা মামলা পরিচালনায় নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
প্রস্তাবিত স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস সংক্রান্ত আইনে এই মর্মে ক্রান্তিকালীন বিধান রাখতে হবে যে, আইন বলবৎ হওয়ার পর থেকে নির্ধারিত সময় (যেমন ১০ থেকে ১৫ বছর) নিম্ন বর্ণিত ব্যবস্থা চালু থাকবেঃ (অ) আইনে বর্ণিত যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে আইন/বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিদ্যমান আইন কর্মকর্তাগণকে অ্যাটর্নি সার্ভিসের বিভিন্ন অনুমোদিত পদের বিপরীতে আত্তীকরণ করা যাবে। আত্তীকৃত কর্মকর্তাগণ বিধি অনুসারে পদোন্নতি লাভ করবেন।
অনুমোদিত পদসংখ্যার বিপরীতে পর্যায়ক্রমে সার্ভিসের প্রবেশ পদে আইন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, যারা বিধি অনুসারে পদোন্নতি প্রাপ্ত হবেন।
এ দিকে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদও একটি স্বাধীন প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। গতকাল একটি সেমিনারে দেয়া বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, দুর্বল তদন্ত ও অপেশাদার প্রসিকিউশন বাংলাদেশে ন্যায় বিচারের অন্যতম অন্তরায়। তিনি প্রসিকিউটরদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন, যাতে তারা ন্যায়বিচার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা গঠন : পুলিশ বাহিনীর অধীনে প্রচলিত তদন্ত ব্যবস্থা এবং তাতে নিয়োজিত জনবলকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত প্রক্রিয়ার যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে।
স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে- তদন্ত সংস্থায় নিয়োজিত জনবলের সমন্বয়ে একটি পৃথক তদন্ত সার্ভিস গঠিত হবে, যার নাম হবে ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস। এ সার্ভিস হবে পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্তাবলি, নিয়ন্ত্রণ, বাজেট, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে।
তদন্ত সংস্থা ও পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বের বিভাজন নির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পুলিশের সহায়তা প্রয়োজন হয় এমন যে কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়ার এবং সাধারণভাবে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে দায়িত্ব থাকে পুলিশের ওপর।
সাধারণত কোনো মামলা দায়ের হওয়ার পরই কেবল তদন্ত সংস্থা কাজ শুরু করবে। তবে জরুরি ক্ষেত্রে এবং ঘটনার জটিলতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে পুলিশ আনুষ্ঠানিক মামলা দায়েরের পূর্বেও সম্ভাব্য তদন্তের অংশ হিসেবে তদন্ত সংস্থার সহায়তা নিতে পারবে। কোনো মামলার তদন্ত শুরুর প্রথম পর্যায় থেকেই তদন্তকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি/প্রসিকিউটরের তদারকিতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধানগুলোর সংশোধনী : বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে সংবিধানের ৬ষ্ঠ ভাগ ও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করাও আবশ্যক বলে কমিশন মনে করে। এ উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গত ২৬ নভেম্বর সংবিধান সংস্কার কমিশনের সাথে মতবিনিময় করে। এতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধানগুলো সংশোধনের ক্ষেত্রে দুই কমিশনের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রয়োজনীয় সংশোধনী বিষয়ে প্রস্তাব করবে।
সে অনুসারে কমিশন সংবিধানের ৪৮ (৩), ৪৯, ৫৫(২), ৮৮, ৯৪, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮, ৯৯, ১০০, ১০৮, ১০৯, ১১১, ১১২, ১১৩, ১১৬ অনুচ্ছেদসহ অন্যান্য অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর সুপারিশ করবে। এ ছাড়া কয়েকটি নতুন বিষয় যেমন- সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন, অ্যাটর্নি সার্ভিস ও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব থাকবে। সংশোধনী ও নতুন বিধানের খসড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন বাস্তবায়ন : কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে প্রহণ করা প্রয়োজন : প্রতি তিন বছর পর পর সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টে প্রেরণ এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা।
প্রতি তিন বছর পর পর সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এবং অধস্তন আদালতের ক্ষেত্রে জেলা আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লিখিতভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে পৌঁছানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ বাক্স স্থাপন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিলের জন্য ডেডিকেটেড ই-মেইল অ্যাড্রেস জনসাধারণকে প্রদান করা।
অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সমন্বয়ে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠন করা। তদন্ত কমিটি প্রতি ৩ মাস পর পর দাখিল হওয়া অভিযোগসমূহ পরীক্ষা করে এবং অভিযুক্তের বক্তব্য শুনে তাতে প্রাইমা ফেসি সত্যতা আছে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অভিযুক্ত বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের বা অন্যবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করবেন।
অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিরীক্ষার জন্য প্রতিটি জজশিপে একজন অতিরিক্ত জেলা জজ, একজন যুগ্ম জেলা জজ ও একজন সিনিয়র সহকারী জজের সমন্বয়ে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা। একইভাবে প্রতিটি ম্যাজিস্ট্রেসিতে একজন এসিজেএম, একজন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সমন্বয়ে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা। উক্ত কমিটিকে ‘দুর্নীতি অনুসন্ধান ও প্রতিরোধ কমিটি’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত সব অভিযোগ উক্ত কমিটি পর্যালোচনা করবে এবং অভিযুক্ত কর্মকতা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে।
আইনজীবীদের দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি জেলায় পৃথক পৃথক অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তির জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।