গুলিবিদ্ধ হয়ে ফুটওভার ব্রিজে পড়েছিলেন মাদরাসাছাত্র সাদ
- আমিনুল ইসলাম
- ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:২৩
পাঁচ আগষ্ট ২০২৪। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিদায়ের খবর শুনে অন্যান্য এলাকার মতো হাজার হাজার মানুষ নেমে আসে মিরপুর-২ এর রাস্তায়। সেখানেই বন্ধুদের সাথে ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী মো: সাদ (২০)। বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে যখন রাস্তায় দাঁড়ানোরও জায়গা হচ্ছিল না তখন তারা কয়েক বন্ধু মিলে উঠে যান মিরপুর শপিংমল ও থানার মাঝের ফুটওভার ব্রিজে। সেখানেই চলতে থাকে তাদের বিজয় উদযাপন। ঘূণাক্ষরেও ভাবেননি এই আনন্দও বিষাদে রূপ নিতে পারে। হঠাৎ করেই আনন্দ মিছিলের উপর এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে পুলিশ। গুলিতে রাস্তার উপর লুটিয়ে পড়ে কয়েকজন। এ সময় ভয়ে আর নিচে নামতে চাননি সাদ ও তার বন্ধুরা। ধারণা করেছিলেন ব্রিজের ওপরেই বোধ হয় নিরাপদে আছেন তারা।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। ওভারব্রিজেরও ওপর থেকে আসা দুটি গুলি আঘাত হানে তার বাম পায়ের থাইয়ে। একটি গুলি হাড়ের মধ্য দিয়ে ঢুকে পায়ের হাটুর বাটিসহ বেরিয়ে যায়। অপরটি থাইয়ের পেছন দিয়ে ঢুকে সামনে দিয়ে বের হয়। এদিকে রাস্তায় পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধদের ততক্ষনে সরিয়ে নিলেও রাত ৮টা পর্যন্ত সাদ পড়ে থাকেন সেই ওভারব্রিজে। প্রচুর রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে পড়ায় সাদ চিৎকার করেও বলতে পারছেন না ‘আমি এখানে পড়ে আছি, কেউ আমাকে বাঁচান’। মনে হয়েছিল এখানেই বোধ হয় মৃত্যু হবে তার। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাত ৮টার দিকে কেউ একজন ওভারব্রিজে উঠে তাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। ৫ আগস্টের পর থেকে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন এই মাদ্রাসাছাত্র।
সাদ জানান, উত্তরা জামিয়াতুল নুর আল কাসেমিয়া মাদ্রাসার ছাত্র তিনি। গ্রামের বাড়ি পাবনায়। থাকতেন মাদ্রাসাতেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে তিনি অন্যদের সাথে উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় অংশ নেন। ৫ তারিখ সকালে জানতে পারেন মিরপুরে আন্দোলনকারীদের উপর ব্যাপক গুলি চালাচ্ছে পুলিশ। তাই উত্তরা ছেড়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে মিরপুরের দিকে রওনা দেন। দুপুর থেকে মিরপুর-১ ও ২ নম্বরে অবস্থান করতে থাকেন। বিকেলে যখন খবর পান শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন তখন শুরু হয় বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ বাসা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। আনন্দ মিছিল করতে থাকেন। মানুষের ভিড়ে জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে মিছিলকে উপভোগ করতে ওভারব্রিজের উপর উঠে যান তিনি। হঠাৎ মিরপুর মডেল থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা গুলি চালাতে চালাতে বের হতে থাকে।
তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত বেশ কয়েকজন রাস্তায় পড়ে থাকে। মানুষ এদিক ওদিক ছুটতে শুরু করে। প্রথমে ভেবেছিলাম উপরে উঠেই ভালো করেছি। আমাদের কেউ দেখবে না, আর গুলিও করবে না। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওভারব্রিজের উপর দিক থেকে আসা দুটি গুলি বাম পায়ে বিদ্ধ হলে লুটিয়ে পড়েন সাদ। তিনি বলেন, একটি গুলি হাঁটু দিয়ে বের হয়েছে। নিচের রাস্তা থেকে গুলি করলে হাঁটুতে লেগে উরু দিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল। তাই ধারণা করছি, মিরপুর শপিংমলের উপর থেকে পুলিশ বা অন্য কেউ ভারী অস্ত্র দিয়ে গুলি করেছে। তিনি বলেন, গুলি লাগার পর বন্ধুরা আমাকে টেনে হিচড়ে সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত নেন। কিন্তু আমার শরীর ভারী হওয়ায় তারা আর নিতে না পেরে অন্যদের ডাকতে চলে যায়। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলেও আর ফিরে আসেনি। এদিতে রাত হতে থাকে। নিচের রাস্তায় গুলিবিদ্ধদের কেউ না কেউ উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার কাছে কেউ আসে না। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় কাউকে ডাকারও শক্তি পাচ্ছিলাম না। শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম। এমন সময় কেউ একজন কোনো কাজে ওভারব্রিজে ওঠেন। তিনি আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। মাথা নেড়ে-চেড়ে দেখেন জীবিত আছি। এরপর কাউকে ডাকতে নিচে নামেন। ভেবেছিলাম তিনিও বোধ হয় আর আসবেন না। কিন্তু কিছু সময় পর আরো কয়েকজনকে নিয়ে আমাকে প্রথমে মিরপুর ড. আজমত আলী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আমাকে রক্ত দেয়া হয়। এরপর ৭ তারিখ সকালে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাঁটু জোড়া লাগলে অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায় তার পা। এখন পাতা ও আঙ্গুলগুলো নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কত সময় লাগবে জানেন না কেউ।