০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পে কচ্ছপ গতি

-

- চার বছরের কাজ ৯ বছরে বাস্তবায়ন হয়নি
- মাঝপথে খরচ বেড়েছে ২৩৪ কোটি টাকা
- সাড়ে ৬ বছরে অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঠেলে ঠেলেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে চলছে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ। অন্যান্য প্রকল্পের মতো বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পগুলোও চলছে কচ্ছপ গতিতে চলছে। চট্টগ্রামের বিদ্যমান বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার পুনর্বাসন ও ক্ষমতা বর্ধিতকরণ প্রকল্পটির কাজ গত সাড়ে ৬ বছরে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪৫.৫৩ শতাংশ। অথচ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ছিল ৪ বছরে। উল্টো মাঝপথে এসে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ব্যয় ১৮৫ কোটি টাকা বৃদ্ধিসহ মোট ২৩৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খরচ বাড়ছে। কাজ কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমলেও খরচ বেড়েছে। আগামীকাল রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রকল্প পরিচালক মো: শামছুদ্দিন দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, দেরিতে শুরু হওয়া, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব, কোভিড চলে আসায় কাজ বন্ধ থাকা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত সাবষ্টেশন করতে সময় বেশি লাগে, সাথে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা।

বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিদ্যমান বিতরণ ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন ও ক্ষমতা বর্ধিতকরণ, ২০৩০ সাল অবধি গ্রাহককে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্প নেয়া হয়। প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হলো, ১২টি ৩৩/১১ কেভি নতুন জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ করা, বিদ্যমান ৬টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র আপগ্রেডেশন, নতুন ২ হাজার ৫৪৭ কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ (১৪ কি.মি. আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলসহ), বিদ্যমান এক হাজার ৫৪১ কিলোমিটার বিতরণ লাইন আপগ্রেডেশন বা রিনোভেশন এবং অফিস ভবন, ডরমেটরি ইত্যাদি নির্মাণ।

প্রকল্পের বেশির ভাগ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি : বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, অনুমোদিত প্রথম সংশোধিত ডিপিপি’র তুলনায় দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র (নতুন) খাতে ১৫৭ কোটি ৩৯.৪৩ লক্ষ টাকা, ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র (আপগ্রেডেশন) খাতে ১৫১ কোটি ১১.৯৭ লক্ষ টাকা, রাজস্ব খাতে ৮ কোটি ২০.৮১ লাখ টাকা, কাস্টমস ডিউটি, কর ও ট্যাক্স খাতে ২৫ কোটি ৬.২১ লাখ টাকা, নির্মাণকালীন সুদ খাতে ৫৯ কোটি ৫১.৩৪ লাখ টাকা, ৩৩ কেভি লাইন (নতুন) অঙ্গে এক কোটি ৩৮.৪৬ লাখ টাকা, ৩৩ কেভি লাইন (রিনোভেশন) অঙ্গে ৪৬.৮৪ লাখ টাকা, ১১ কেডি লাইন (নতুন) অঙ্গে ৫ কোটি ৫৭.৫ লাখ টাকা, ১১ কেভি লাইন (রিনোভেশন) খাতে ৮৬.০১ লাখ টাকা, ১১/০.৪ কেডি লাইন (নতুন) অঙ্গে ৯ কোটি ৮৩.০৭ লাখ টাকা, ১১/০.৪ কেডি লাইন (রিনোভেশন) অঙ্গে এক কোটি ১৯.৪১ লাখ টাকা, ০.৪ কেডি লাইন (নতুন) খাতে তিন কোটি ৫৫.৮১ লাখ টাকা, ০.৪ কেভি লাইন (রিনোভেশন) খাতে এক কোটি ৮৪.২৭ লাখ টাকা এবং প্রাইস কনটিনজেন্সি খাতে ২৪ কোটি ৯৩.০৫ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যয় কমেছে কয়েকটি খাতে : অপর দিকে, প্রথম সংশোধিত ডিপিপি’র তুলনায় দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে ৩৩ কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন খাতে ২৯০ কোটি ৮৭.৩১ লাখ টাকা, ডরমেটরি খাতে ৬৫ হাজার টাকা, ১১/০.৪ কেভি ২৫০ কেডিএ (নতুন) বিতরণ ট্রান্সফরমার খাতে সাত কোটি ৫৫.১৫ লাখ টাকা, ৬.২৩/০.২৩ কেভি ৫০ কেডিএ/২৫ কেভিএ বিতরণ ট্রান্সফরমার খাতে এক কোটি ৩৫.১৭ লাখ টাকা ব্যয় কমেছে।

সার্বিকভাবে, দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে প্রকল্পের মোট ব্যয় ১৮৫ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা বা ৭.১৪ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ডলার ও ইউরোর বিনিময় হারের তারতম্যের কারণে ব্যয় বেড়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান।
সাড়ে ৬ বছরে অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ : প্রকল্পটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৩৩২ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৯৬৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকা এবং বাস্তব অগ্রগতি ৪৫.৫৩ শতাংশ।
প্রকল্পের মেয়াদ আরো ২ বছর বাড়ছে : প্রকল্পের আওতায় সর্বনিম্ন দরদাতাদের সাথে টার্ন-কী চুক্তি স্বাক্ষরের আগে ডিপিপি’র সংশোধন, ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন ও চুক্তি স্বাক্ষর পর্যন্ত আরো প্রায় ২-৩ মাস এবং চুক্তি স্বাক্ষরের পর টার্ন-কী কাজের মালামালের এলসি খুলতে আরো প্রায় এক থেকে দুই মাস সময় লাগতে পারে। টার্ন-কী কাজগুলোর বাস্তবায়নকাল ২ বছর যার গণনা এলসি বা ঋণপত্র খোলার তারিখ থেকে শুরু হবে। বর্ণিত অবস্থায় প্রকল্পের টার্ন-কী কাজগুলো ডিপিপি’র বর্তমান অনুমোদিত মেয়াদকাল অর্থাৎ জুন ২০২৫ এর মধ্যে সমাপ্ত করা সম্ভব হবে না। প্রকল্পের আওতায় উক্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতে আরো ২ বছর সময় প্রয়োজন। তৎপ্রেক্ষিতে, দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নকাল ২ বছর অর্থাৎ জুন ২০২৭ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৯ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় কিছু শর্তসাপেক্ষে একনেকে পেশ করার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। সাড়ে ৬ বছরে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। যে প্রকল্পটি ৪ চার বছরে শেষ করার জন্য অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৮ সালে। পিইসি সংশ্লিষ্টরা বলেন, এরপর আর প্রকল্পটি সংশোধন করা হবে না।
বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পের ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সম্প্রতি মিডিয়া ব্রিফিংএ বলেন, দেশের বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের সঙ্কট আবদ্ধ দুষ্টচক্রে। তিনি বলেন, সঠিক পরিকল্পনা ও সমীক্ষা না নিয়ে প্রকল্প নেয়ার কারণে যথাসময়ে সমাপ্ত করতে পারছে না।

প্রকল্পের কাজ শেষ হতে বেশি সময় লাগার বিষয়ে পিডি মো: শামছুদ্দিনের কাছে গতকাল মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকল্পটি শুরুই হয়েছে বিলম্বে। এরপর করোনার কারণে প্রকল্পটি আবার থমকে যায়। আন্তর্জাতিক টেন্ডার-রি-টেন্ডার হওয়াতে সময় নষ্ট হয়। একটা রিটেণ্ডার করতে এক বছরের বেশি সময় লাগে। আবার একনেক থেকে ফেরত এলো। এতে আরো আট মাস নষ্ট হলো। তিনি বলেন, সব প্রকল্পই যেভাবে সময় গণনা করে ধরা হয় তার চেয়ে পরে শুরু করা হয়। প্রকল্প পরিচালক এই প্রকল্পে নিয়োগ পেতে আট মাস সময় চলে যায়। এখানে প্রায় এক বছর শেষ। এরপর করোনা এলো। করোনার সময় জমি অধিগ্রহণেও অনেক সময় লেগেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক মার্কেটে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, জাহাজের ভাড়া বেড়ে যায়। টেন্ডারের দামও বেড়ে যায়। রিটেন্ডার শেষ করে গত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে একনেক থেকে ফেরত পাঠায়। আবার পিইসি করতে হয়েছে। তিনি বলেন, আগামীকাল একনেকে অনুমোদন পর কোনো ধরনের সমস্যা না হলে প্রস্তাবিত সময়েই প্রকল্পটি সমাপ্ত করতে পারব ইনশাআল্লাহ।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল