০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন

রেজওয়ানকে কোপাতে থাকে ছাত্রলীগ

রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রেজওয়ান : নয়া দিগন্ত -

বাবা ছেলে এক সাথেই যুক্ত হয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। কাছাকাছিই থাকতেন তারা। গত ৪ জুলাই সারা দেশের মতো কিশোরগঞ্জেও আন্দোলনের মাত্রা তীব্র হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা পেটে ছুরি ঢুকিয়ে হত্যা করে ছেলের নারী সহপাঠীকে। চরম উত্তেজনায় বাবার হাত ছেড়ে মিছিলের সামনে চলে যান ছেলে। কিন্তু এলোপাতাড়ি গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে একটি গলির মধ্যে আশ্রয় নেয়। এই সুযোগে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে ছেলে রেজওয়ানকে (২০)। হাঁটুর গিরার ওপর রামদা দিয়ে কুপিয়ে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এ ছ্ড়াাও শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে ফেলে যায়। পরে রেজওয়ানের বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হসপিটালে পাঠায়। কিন্তু তখনও ছেলের এই খবর জানতেন না বাবা মাহফুজ আহমেদ।
রেজওয়ানের পায়ের ক্ষত সেরে গেলেও এখনো হাঁটুর জয়েন্ট ঠিক হচ্ছে না। হাঁটতে গেলেই হাঁটুর ওপরের ও নিচের অংশ জয়েন্ট থেকে সরে যাচ্ছে। যার কারণে মাসে পর মাস ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতালে রেজওয়ান জানান, তিনি কিশোরগঞ্জ ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজের এইচএসসির ছাত্র। বাবা মাহফুজ এলাকায় ব্যবসা করেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই বাবা-ছেলে মিলে অংশ নিচ্ছিলেন। প্রতিদিনই বাবার সাথেই বের হতেন তিনি। কিশোরগঞ্জ সদরের যে স্পটেই থাকতেন বাবাও তার পাশাপাশিই থাকতেন। কিন্তু ৪ তারিখ সকাল থেকে আন্দোলন তীব্র হতে শুরু করে। এর আগে আন্দোলনরত তার কলেজের একটি মেয়ের পেটে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে ছাত্রলীগের তৌফিকসহ অন্যরা। যার কারণে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকাল থেকে বাবার সাথে গৌরাঙ্গবাজার এলাকা ছিলাম। কিছু সময়ের মধ্যে মিছিল তীব্র হওয়ায় তার কাছ থেকে সামনে চলে যাই। সম্ভবত বাবাও টের পাননি আমি সামনে চলে গেছি। আন্দোলনকারীরা সামনে থাকা ছাত্রলীগকে ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে মিছিল করতে থাকে। এমন সময় পুলিশ আমাদের মিছিল লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় বিক্ষোভকারীরা। ঠিক তখনই পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে অস্ত্র হাতে হামলে পড়ে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা।

খালি হাতে আমরা পাশের একটি গলির মধ্যে ঢুকে পড়ি। ওই গলিতে রামদা-চাপাতিসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে ঢুকে ছাত্রলীগের তৌফিকসহ অন্যরা। তারা ছাত্রদের এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। একজন ওয়াল টপকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যখন ওয়ালের ওপর ওঠে তখন নিচ থেকে রামদা দিয়ে তার পিঠে কোপ দেয় ছাত্রলীগের সেই তৌফিক। এতে রামদার সামনের বাঁকানো অংশ ঢুকে যায় শিক্ষার্থীর পিঠে। এরপর রামদাসহ টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয় তাকে। এই দৃশ্য দেখে মাথায় থাকা বাংলাদেশের পতাকা হাতে পেঁচাতে শুরু করি। কোপ দিলে পতাকা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করবো। ভাবতেই তারা ঘিরে ধরে আমাকে। প্রথমে রড-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর শুরু করে রামদা দিয়ে কোপানো। পতাকা হাতে প্যাঁচালেও তাদের কোপ ঠেকানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তৌফিক পায়ের ঠিক হাঁটু বরাবর একের পর এক কোপ দিয়েই চলে যায়। ওই টার্গেট ছিল পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলার। প্রায় করেও ফেলেছিল। তবে তার আগেই আমার সহপাঠীরা ছুটে আসায় পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ।

রেজওয়ান বলেন, প্রথমে এলোপাতাড়ি পেটানোর কারণে কোমরের কোথাও একটি আঘাত লেগে পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে যায়। এতে করে আর কোনো ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল না। তৌফিক এতগুলো কোপ দিলেও আমি ব্যথা পাচ্ছিলাম না। এরপর আমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পপুলার হসপিটালে নেয়া হলো। সেখানে চিকিৎসকরা আমার অবস্থা দেখে চিকিৎসা দিতে চাইছিলেন না। তারপরও শিক্ষার্থীদের চাপে কোনো রকম ব্যান্ডেজ করে দিয়ে পাশে চাচীর বাসায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর রক্তক্ষরণ শুরু হলে রাতে আবার নেয়া হয় পপুলার হসপিটালে। এর মধ্যে খবর পান বাবা মাহফুজ। তিনি ছুটে আসেন হাসপাতালে। সেখান থেকে নেয়া হয় কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু ক্ষত শুকিয়ে গেলেও হাঁটতে পারছিলাম না।
পরে ২ সেপ্টেম্বর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এখন সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় রেজওয়ান।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল