৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৫
`

হাসপাতাল থেকেই পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন অদম্য আবদুল্লাহ

পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবদুল্লাহ আহমেদ : নয়া দিগন্ত -

পায়ের গোড়ালি থেকে ঊরু পর্যন্ত পাঁচ ধাপে প্রায় ২৫টি রড ঢুকিয়ে বসানো হয়েছে এলিজা। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেও পড়াশোনার হাল ছাড়েননি। শত কষ্ট সহ্য করে হাসপাতাল থেকেই কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন অদম্য আবদুল্লাহ আহমেদ (১৮)। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ। কলেজ কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের বিছানায় বসেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সহপাঠীরা ভাবতে পারে আবদুল্লাহ সেখানে কোনো অনৈতক সুবিধা নিয়েছে। এ ধরনের কোনো বিতর্কে না গিয়ে বাবার সাথে গাড়িতে করে কলেজে গিয়েই পরীক্ষা দিচ্ছেন তিনি।
আবদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায়। পরিবারের সাথে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন ইসিবি এলাকায় বসবাস করেন। বাবা শাহাদাৎ হোসেন পেশায় একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু গত সাড়ে ৫ মাসে ছেলের চিকিৎসার পেছনে অর্থ আর সময় দিতে গিয়ে তার ব্যবসা এখন শেষ হওয়ার পথে। পরিবারের প্রথম সন্তান আদরের আবদুল্লাহ হাসপাতালে একা থাকবে এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি শাহাদাৎ হোসেন। এত দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকতে থাকতে ছেলে যাতে মানসিকভাবে অসুস্থ না হয়ে পড়ে সে জন্য সব ছেড়ে তার পাশেই থাকেন তিনি।
পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে আবদুল্লাহ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রীয় ছিলেন তিনি। বন্ধুদের সাথে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আন্দোলন করেছেন। তবে বেশির ভাগ সময় কেটেছে ইসিবি চত্বর এলাকায়। গত বছরের আগস্টের শুরু থেকে সারা দেশে আন্দোলনের মাত্রা তীব্র হয়ে ওঠে। ৪ আগস্ট সকাল থেকেই ইসিবি এলাকায় মিছিল করেন তারা। সেখানে পুলিশের সাথে কয়েকবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ সেখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খবর আসে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় ছাত্রলীগ-পুলিশ মিলে আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক গুলি চালাচ্ছে। খবর পেয়ে ইসিবি চত্বর ছেড়ে আমরা কয়েকজন ছুটতে থাকি ১০ নম্বরের দিকে। কোনো যানবাহন ছাড়াই দৌড়ে ও হেঁটে চলে যাই সেখানে। দেখি ঘটনা সত্য। পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি চালাচ্ছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় তারা গুলি চালিয়ে পেরে উঠছিল না। পরে পিছু হটতে শুরু করে হামলাকারীরা।
এক পর্যায়ে পুলিশ গাড়িতে উঠে দ্রুত গতিতে হামলাকারীদের উপর তুলে দেয়। তখন পুলিশের গাড়ির নিচে চাপা পড়ি আমিসহ কয়েকজন। গাড়ির চাকা আমার ডান পায়ের ওপর উঠে যায়। এতে হাড় ভেঙে পা পিচের সাথে চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এর পর বন্ধুরা ধরাধরি করে স্থানীয় একটি হসপিটালে নিয়ে গেলে প্রথমে তারা রাখতে চায়নি। পরে চাপাচাপিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে যেতে বলে। কিন্তু তখন আমার বাবা জানতে পারেন যে, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ঢুকে ছাত্রলীগের গুণ্ডারা আহতদের মেরে ফেলছে। আবার চিকিৎসকরাও ভালো করে চিকিৎসা দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। তাই, তিনি নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাকে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে নিয়ে যান। সেখানে পাচ্চর এলাকার রয়েল হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসকদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও প্রয়োজনীয় অনেক মেশিনপত্র ছিল না। অবশেষে স্বৈরাচার পতনের পর ৭ আগস্ট আমাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আবদুল্লাহ বলেন, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, স্কুল-কলেজ খুলেছে। কিন্তু আমি যেতে পারি না। হাসপাতালের বিছানায় বসে-শুয়ে যতটুকু পারছি পড়াশোনা করছি। বর্তমানে কলেজে নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আমি হাসপাতাল থেকেই বাবার সাথে কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসছি। যদিও কলেজ কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন হাসপাতালেই পরীক্ষা দেয়ার একটি ব্যবস্থা করে দিবেন। কিন্তু আমি তাদের কষ্ট দিতে চাইনি। তা ছাড়া সহপাঠীরা ভাবতে পারে আমি হাসপাতালে বসে অনৈতিক কোনো সুবিধা নিয়েছি।
আবদুল্লাহর বাবা শাহাদাৎ বলেন, প্রথম বাবা ডাক শুনেছি আবদুল্লাহর কাছ থেকে। তার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারি না। তাই কাজ ফেলে ছেলেটার পাশে থাকার চেষ্টা করি। তিনি বলেন, কষ্ট হলেও পরীক্ষা দিতে তাকে কলেজে নিয়ে যাচ্ছি। ভাবি, এতে হয়তো ছেলেটা একটু মানসিক শান্তি পাবে। হাসপাতালে থাকতে থাকতে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কলেজে গেলে বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, কথা বলতে পারবে।
শাহাদাৎ হোসেন সবার কাছে দোয়া চাইলেন, যাতে তার ছেলেটি সুস্থ হয়ে আবার সবার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement