৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ২৯ রজব ১৪৪৬
`

গাজায় ফেরা ফিলিস্তিনিদের সামনে কেবলই ধ্বংসস্তূপ

-

- যুদ্ধবিরতির মধ্যেই ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা
- উত্তরাঞ্চলে ফিরেছে ৩ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি
- গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জীবন সঙ্কটে
- ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া আরো ৪৮ লাশ উদ্ধার

গাজা ভূখণ্ডের উত্তরে বাড়ি ফিরে ‘ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই’ খুঁজে পাচ্ছে না ফিলিস্তিনিরা। গাজার সরকারি গণমাধ্যম জানিয়েছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চল থেকে এসে তিন লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, শেষ ৪৮ ঘণ্টায় গাজার হাসপাতালগুলোতে উদ্ধার হওয়া আরো ৪৮ জনের লাশ আনা হয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে সাম্প্রতিক ইসরাইলি হামলায় নিহত ১১ জন এবং আগের হামলার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া ৩৭ জনের উদ্ধার হওয়া লাশ রয়েছে। আলজাজিরা ও বিবিসি।
এ দিকে উত্তরাঞ্চলের নুসাইরাতে যুদ্ধবিরতির মধ্যেই ইসরাইলি হামলায় এক শিশুসহ দুই ফিলিস্তিনি নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। খবর অনুসারে মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের পশ্চিমে ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের বহনকারী একটি ঘোড়ার গাড়িটিতে গোলাবর্ষণ করে এবং এতে পাঁচ বছর বয়সী নাদিয়া মোহাম্মদ আল-আমাউদি নিহত এবং আরো তিনজন আহত হয়।
গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা ৪৪ বছর বয়সী সাবরাইন জানুন বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা আবার আমাদের পরিবার ও স্বজনদের দেখতে পেয়ে খুশি...(কিন্তু) সেই সাথে কান্না আসছে বিধ্বস্ত বাড়িঘর, ধ্বংসস্তূপ দেখে।’ সাবরাইন আরো বলছিলেন, ‘নৈসর্গিক দৃশ্যের টানে লোকজন এখানে হাঁটতে আসতেন। এখন এর অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।’

যুদ্ধবিরতির পর গত সোমবার সকালে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজায় ফিরতে উপত্যকার উপকূলীয় সড়ক ‘আল রশিদ স্ট্রিট’ খুলে দেয় ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। এ সময় বাড়িমুখী মানুষের ঢলে শামিল হন সাবরাইন। গাজার একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, দুই ঘণ্টায় দুই লাখের বেশি ফিলিস্তিনি এ সড়ক ধরে উত্তরাঞ্চলে ফিরেছেন। এ যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিসিকে অনেক ফিলিস্তিনি তাদের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা জানান। এমন ফিলিস্তিনিদের একজন ২৪ বছর বয়সী ইসরা শাহিন। গাজা সিটিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর তিনি বলছিলেন, ‘এটা অনেক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর এক যাত্রা।’
ইসরা বলছিলেন, ‘মাঝপথ পর্যন্ত লোকজন আনন্দেই ছিল, তারা গাইছিল ও সে রকমই কিছু করছিল। কিন্তু বাড়ি পৌঁছাতে যত সময় লাগছিল, ততই তারা হতাশ হচ্ছিল। শেষমেশ আমরা যখন ‘গাজায় স্বাগতম’ লেখা এক প্রতীকের কাছে পৌঁছালাম, তখন ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে বহু মানুষ আবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে।’ অনেকে আবার ভিন্নপথে গাড়িতে করে গাজার উত্তরে রওনা করেন।

৪২ বছর বয়সী আরেক ফিলিস্তিনি ওয়াফা হাসুনা বলছিলেন, ‘উত্তর গাজা অভিমুখী সড়কটিতে তখন হাজার হাজার মানুষ। গোটা সড়কজুড়ে আমরা খুব আনন্দে ছিলাম। তবে মনে মনে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। কারণ, আমি জানি, আমি গাজা সিটিতে পৌঁছাব ঠিকই, কিন্তু আমার বাড়িটা সেখানে আর নেই।’ এই ফিলিস্তিনিরা যখন গন্তব্যে পৌঁছালেন, তখন বিধ্বস্ত বাড়িঘর আর ধ্বংসস্তূপ দেখে নিজেদের মধ্যে কষ্টের কথা বলাবলি করতে লাগলেন।
তবু এই ফিলিস্তিনির আশা, এ যুদ্ধ একদিন শেষ হবে এবং যা ধ্বংস হয়ে গেছে তার সব আবারো নির্মাণ করতে পারবেন। আরেক ফিলিস্তিনি জানান, তার ভাই এখনই ফিরতে তাকে মানা করেছেন। ভাই তাকে ফোন করে বলেছেন, ‘বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাড়িফেরা লোকজন রাস্তায় ঘুমাচ্ছেন। তাদের সাহায্য করার কেউ নেই।’

ফিরেছেন ৩ লাখ ফিলিস্তিনি : এদিকে নিজ নিজ বাড়ির খোঁজে এলাকায় ফিরে আসা ফিলিস্তনিদের ‘অপরিসীম’ সহায়তা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। গাজার উত্তরাঞ্চলে থাকা আলজাজিরার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, জোর করে বাস্তুচ্যুত করা তিন লাখের বেশি ফিলিস্তিনি প্রায় ১৫ মাস পর উত্তর গাজায় নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে খুঁজে দেখছেন কী অবশিষ্ট আছে। সোমবার থেকে ফিরতে শুরু করা এসব লোকজন ‘ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না।’
ফিরে আসার পথে অন্তত দু’জন ডায়রিয়া ও তীব্র ক্লান্তি নিয়ে মারা গেছেন। অন্যরা পরিবার পরিজন নিয়ে ফেরার পথে আছেন। সোমবার যে কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি গাজার উত্তরাঞ্চলে ফিরেছেন তারা তাদের ‘অনেক আপনজনকে খুঁজে পেয়ে খুশি’ হলেও ১৫ মাসের টানা যুদ্ধের পর উত্তর গাজার ইসরাইলি চেকপোস্ট থেকে মালপত্রসহ সাত কিলোমিটার হেঁটে বাড়িতে ফেরার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

জাতিসঙ্ঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় দফতরের (ওসিএইচএ) কর্মকর্তা গ্লোরিয়া ল্যাজিক বলেছেন, ‘সেখানে কিছুটা আশঙ্কাও আছে। হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থায় পাবে।’ সোমবার স্থানীয় সময় সকাল থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি উত্তরাঞ্চলে তাদের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়ি ও এলাকায় ফিরতে শুরু করলেও তাদের মনোবল অটুট ছিল। পরিবারসহ গাজা সিটিতে ফিরতে থাকা রানিয়া মিকদাদ বলেন, ‘ফেরার মধ্য দিয়ে আমরাই বিজয়ী।’
স্বাস্থ্যসেবা বাধাগ্রস্ত : অন্যদিকে গাজায় যুদ্ধ ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে সেখানকার গর্ভবতী নারী ও নবজাতকদের জীবন চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ার ফলে এই সঙ্কট আরো তীব্র হয়েছে। গত ১৫ মাস গাজায় লাগাতার ইসরাইলি হামলা এবং এর সাথে যুক্ত অবরোধের কারণে স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও পানীয় জলের মারাত্মক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গর্ভবতী নারীরা হাসপাতাল থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, আর নবজাতকরা প্রয়োজনীয় যতœ পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ইসরাইল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করছে।

গাজায় গর্ভবতী নারীদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় যুদ্ধাহতদের জন্য তাদের দ্রুত সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। নবজাতক শিশুদের জন্য ইনকিউবেটর এতটাই কম যে এক ইনকিউবেটরে চার থেকে পাঁচটি শিশু রাখতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই শিশুগুলোর বেশির ভাগই মারা যাচ্ছে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে। শীতের তীব্রতায় আশ্রয়ের অভাবে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে। এইচআরডব্লিউর খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরাইলি আইন অনুযায়ী গাজায় জাতিসঙ্ঘের সাহায্য সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-এর কার্যক্রমে বাধা প্রদান করা হচ্ছে, যা মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে গাজায় ১৮টি আংশিক কার্যকর হাসপাতালের মধ্যে মাত্র সাতটি জরুরি প্রসূতি সেবা দিতে সক্ষম, তাও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
গাজার হাসপাতালগুলোতে ওষুধ, টিকা এবং বিশুদ্ধ পানির অভাব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। চিকিৎসকরা ক্ষুধার্ত, অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত এবং তারা প্রায়শই সামরিক হামলার মুখোমুখি হচ্ছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গর্ভপাতের হার ৩০০ শতাংশ বেড়েছে, এবং নবজাতক শিশু ঠাণ্ডায় মারা যাচ্ছে।
এইচআরডব্লিউয়ের মতে, শুধু যুদ্ধবিরতি এই সঙ্কট সমাধান করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যেন গাজায় গর্ভবতী নারী ও নবজাতকদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়। গাজার জনগণের মানবাধিকার রক্ষার জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement
১৫ দিন বাড়তে পারে আয়কর রিটার্ন জমার সময় ঢাকায় লেনদেন শুরু সূচকের উত্থানে, চট্টগ্রামে পতন মুন্সিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১, আহত ১৫ পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ১০ সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় পরিবর্তনে কী লাভ গ্রাহকের যুক্তরাষ্ট্রে অবতরণের সময় যাত্রীবাহী বিমানের সাথে হেলিকপ্টারের সংঘর্ষ পঞ্চগড়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ, তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রির ঘরে বড় জয়েও অপেক্ষা বাড়ল রিয়াল মাদ্রিদের সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনা চালু করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুবসমাজকে বৈশ্বিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত করাই লক্ষ্য : আসিফ নজরুল ভেনেজুয়েলার ৬ লাখ অভিবাসীকে ডিপোর্ট করছে যুক্তরাষ্ট্র

সকল