নৈসর্গিক সৌন্দর্যের চর হেয়ার
- রফিকুল ইসলাম রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)
- ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৪, আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩২
বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপটি সেজে আছে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে। গুগল ম্যাপে যার নাম ‘হেয়ার আইল্যান্ড’। কারো কাছে ‘চর হেয়ার’, কারো কাছে ‘কলাগাছিয়া চর’ নামেও পরিচিত। দ্বীপটিতে আছে চোখজুড়ানো বালুকাময় দীর্ঘ সৈকত। সাগরের বিশাল জলরাশি। তটরেখায় লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। সারি সারি ঝাউবন, আর সাগরে শো শো শব্দ।
নয়নাভিরাম সাগরকন্যা খ্যাত এই চর হেয়ার পটুয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিণের সাগর সান্নিধ্যের ভূখণ্ডে রাঙ্গাবালী উপজেলা থেকে নৌপথে ১৫ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াতের মাধ্যম একমাত্র নৌপথ। ইঞ্জিন চালিত কাঠের নৌকা কিংবা স্পিডবোটে সেখানে পর্যটকরা আসে-যায়। সে পথে যেতে বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর ধারে দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোলেই প্রথম দেখা মিলবে ঘন ম্যানগ্রোভ বন ‘চর তাপসি’। পূর্ব দিকে রয়েছে অপরূপ আরেকটি দ্বীপ, যার নাম ‘সোনারচর’। যেটি দেখতে অনেকটাই সুন্দরবনের মতো। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে গেলেই দেখা মিলবে ডিমাকৃতি ‘হেয়ার আইল্যান্ড’। যেখানে ভ্রমণপিপাসুদের একবার পা পড়লেই বার বার আসতে মন চাইবে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ছুটে আসছেন ভ্রমণপিপাসুরা।
চারদিকে চোখজুড়ানো বালুকাময় সৈকত। লাল কাঁকড়ার দল। অতিথি পাখির কলকাকলি। সবুজ ঘন বনায়ন। এর মধ্যে গাছের ঝরা পাতা এমনভাবে বিছিয়ে আছে দেখলে মনে হবে ঝাউ পাতার কার্পেট দিয়ে আপনাকে কেউ স্বাগত জানাচ্ছে। বনের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে আরো চোখে পড়বে নানা আকারের ছইলা, কেওড়া, বাইন, গোলপাতা, হারগুজি, তাম্বুরা কাটার ঝোপঝাড়। আর সেই ঝোপঝাড়ে দেখা মিলবে ঝাঁকে ঝাঁকে চেনা-অচেনা পাখি।
দ্বীপটিতে আছে কাকডাকা ভোরে সাগরের বুকে সূর্যোদয় আর সাঁঝবেলায় সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ। এমন সব সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে এমনিতেই আকর্ষণীয়। তাই এই চর হেয়ারকে বলা হয় মিনি কুয়াকাটা। সেই আকর্ষণ আরো বাড়াতে সম্প্রতি বেসরকারি উদ্যোগে ভ্রমণপিপাসুদের বিশ্রামের জন্য চেয়ার, রঙিন ছাতা এবং গাছে গাছে ঝুলন্ত দোলনাও দেয়া হয়েছে হেয়ার আইল্যান্ডে। ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য ডাস্টবিনও বসানো হয়েছে।
সাড়ে ছয় কিলোমিটার আয়তনের চর হেয়ার বা হেয়ার আইল্যান্ডে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে তাঁবু টানিয়ে সেখানে ক্যাম্প করে থাকছেন পর্যটকরা। রয়েছে টয়লেট ও টিউবওয়েল, যা ভ্রমণ পিপাসুদের দারুণ উপকারে লাগছে। বিভিন্ন পর্যটক গ্রুপ করে এখানে এসে তাঁবু করে থাকছে। রাতে এখানে বারবিকিউ করা হয় রাতের খাবারের অংশ হিসেবে। এই পর্যটকরা রাতে বনের পরিবেশ উপভোগ করছেন। এই বনে আছে শিয়াল, মহিষ, হরিণ, সাপসহ আরো বন্য প্রাণী। বনের ভেতর থাকা খালের পাড়ে বিভিন্ন জাতের মাছরাঙার দেখা মিলবে মাছ শিকারে। আবার চিল বা বাজপাখির বিশাল বিশাল মাছ শিকারের দৃশ্যও চোখে পড়বে। পর্যটকদের কেউ চর মোন্তাজ থেকে, কেউ ভোলা থেকে, কেউবা কুয়াকাটা থেকে ট্রলার বা স্পিডবোট ভাড়া করে আসেন চর হেয়ারের সৌন্দর্য দেখতে।
ঘুরতে আসা পর্যটকরা বলছেন, থাইল্যান্ডের ফি ফি আইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের মতো করে সাজানো যায় এই হেয়ার দ্বীপকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে হেয়ার আইল্যান্ড, সোনারচর, জাহাজমারার চর ও চর তুফানিয়া নামক চারটি পর্যটন স্পট নিয়ে পর্যটন জোন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পর্যটকরা মনে করেন, পার্শ্ববর্তী পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র থাকায় এখানকার পর্যটন সম্ভাবনাও বেড়েছে কয়েক গুণ।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক পর্যটক আকৃষ্ট করতে দক্ষিণ অঞ্চলের পর্যটন উন্নয়নে ‘পায়রা বন্দর নগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ পর্যটনভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প এলাকায় বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। পর্যটকরা বলছেন, এই প্রকল্প এলাকা থেকে রাঙ্গাবালীর পর্যটন স্পটগুলোতে আসা-যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলে কুয়াকাটার পাশাপাশি এখানকার পর্যটন সম্ভাবনাও বিকশিত হবে। সে ক্ষেত্রে কুয়াকাটা এবং পায়রা বন্দর এলাকা থেকে নৌপথে রাঙ্গাবালী আসা-যাওয়ার জন্য সি-ট্রাক কিংবা শিপ চালু করা যেতে পারে; বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাঙ্গাবালীর পর্যটন উন্নয়নে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী হোসাইন বলেন, ‘এ অঞ্চলটি পর্যটকবান্ধব। তাই পর্যটন উন্নয়নে এখানে অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। সবাই এগিয়ে আসলে এখানকার পর্যটন সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়নের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও যদি এখানে হোটেল-মোটেল করে তা হলে এখানকার পর্যটন সম্ভাবনার বিকাশ ঘটবে বলে আমি মনে করি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ইকবাল হাসান বলেন, ‘এ দ্বীপগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পর্যটন জোন করে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যটকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্পট হবে। তখন এখানে দেশী পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকরাও ছুটে আসবে।’
তবে কোনোভাবেই যেন এই ছোট্ট দ্বীপটির প্রাকৃতিক পরিবেশ জীববৈচিত্র্য নষ্ট না হয় সে দিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর রাখার দাবি ভোলা থেকে আসা পর্যটক মিজানুর রহমানের। যিনি পুরো পরিবার নিয়ে স্পিডবোট ভাড়া করে এসেছেন চর হেয়ারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা