অর্থ আত্মসাতের আসামিকে ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লির সুপারিশ!
উত্তরার আজমপুর এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ : ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৪
নতুন ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র উত্তরার ৪ নাম্বার সেক্টরের আমিন উদ্দিন আহমেদ ওয়াকফ এস্টেটে মসজিদ মাদরাসার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার কারণে বরখাস্তকৃত একজনকে আবার মোতাওয়াল্লি হিসেবে ফেরানোর আয়োজন হচ্ছে। ওয়াকফ এস্টেট কর্তৃপক্ষ মোতাওয়াল্লি পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করলেও নতুন করে তাকে ফেরানোর জন্য সুপারিশ করেছেন একজন ওয়াকফ পরিদর্শক।
হাজী নাছির উদ্দিন নামের জাতীয় পার্টির এক সময়ের নেতার বিরুদ্ধে মসজিদের অর্থ আত্মসাতের জন্য ফৌজদারি মামলা হয়েছে এবং এই মামলায় তিনি জেল খেটে এখন জামিনে আছেন। এই মামলা এখন আর চলমান নেই বলে নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে দাবি করেছেন হাজী নাছির। অন্যদিকে ওয়াকফ এস্টেট কমিটির সভাপতি মেজর (অব:) আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, অর্থ আত্মসাতের এই মামলা চলমান রয়েছে। এই ব্যাপারে চার্জশিট প্রদান এবং চার্জগঠনের পর মামলাটি এখন বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
এই মামলার বিষয়ে ওয়াকফ পরিদর্শক আবুল কাশেমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, হাজী নাছিরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে এ রকম কোনো তথ্য তাকে কেউ দেয়নি। অন্য দিকে সরকার পরিবারের সিনিয়র সদস্য মো: আবুল কাশেম সরকার জানিয়েছেন, গত ৮ অক্টোবর ওয়াকফ পরিদর্শক আবুল কাশেম কোনো প্রকার নোটিশ ছাড়াই নতুন করে মোতাওয়াল্লি হওয়ার জন্য আবেদনকারী হাজী নাছির উদ্দিন সরকারের সাথে যোগসাজশ করে কিছু সন্ত্রাসী ব্যক্তি নিয়ে তদন্তে উপস্থিত হন। এর ফলে তদন্তকালে হইচই হট্টগোল শুরু হয়। এমতাবস্থায় ওয়াক্ফ পরিদর্শক আবুল কাশেম তদন্তকাজ সম্পন্ন না করে চলে যান এবং পরবর্তীতে তদন্তের তারিখ জানাবেন বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু গত ২১ জানুয়ারি জানা যায় যে তিনি তদন্ত সম্পন্ন না করে এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র গ্রহণ না করেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হাজী মো: নাছির উদ্দিনকে মোতাওয়াল্লি নিয়োগের সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
এ প্রসঙ্গে পরিদর্শক আবুল কাশেম নয়া দিগন্তকে বলেন, তিনি তদন্তকার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন এবং যাদের সাথে কথা বলেছেন তাদের স্বাক্ষর নিয়ে রেখেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, নাছির সরকারকে তিনি মোতাওয়াল্লি করার বিষয়ে সুপারিশ করেছেন। এই সুপারিশের ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়েছে যে পরিদর্শক কাসেম আর্থিক সুবিধা নিয়ে এই সুপারিশ করেছেন এবং ওয়াকফ এস্টেট অফিসের সিসিটিবি পরীক্ষা করলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। এ ধরনের অভিযোগ কাসেম সত্য নয় বলে দাবি করেছেন।
এদিকে আবুল কাশেম সরকার ওয়াকফ প্রশাসনে এক আবেদনে বলেছেন, হাজী নাছির উদ্দিন সরকার বিগত ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোতাওয়াল্লির দায়িত্বে থাকাকালীন এস্টেট পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। অর্থ আত্মসাৎ, অসদাচরণ, দলিলের শর্তের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের কারণে ওয়াকফ প্রশাসক ওয়াকফ আইনের ৩২ (১) ধারামতে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফয়েজ আহমেদ ভূঁইয়া (অতিরিক্ত সচিব), ওয়াক্ফ প্রশাসক স্বাক্ষরিত আদেশে নাছির উদ্দিন সরকারকে অপসারণ করে। নাছির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে উত্তাপিত অভিযোগের মধ্যে এস্টেটের দায়িত্বে থাকাকালীন ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বিভিন্নভাবে আত্মসাৎ করার বিষয়টিও রয়েছে। ওই অর্থ আদায়ের জন্য সিএমএম আদালতে সিআর ১৩২৩/২০২১ নং মামলা চার্জগঠন শেষে এখন সাক্ষ্যের জন্য অপেক্ষমাণ আছে। এই মামলায় গত ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট নাছির উদ্দিন ও তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
হাজী নাছির সরকার এই মামলার বিষয়টিকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। এই মামলায় তার জেল খাটার বিষয়টি স্বীকার করলেও তিনি উল্লেখ করেন, আগের সরকারের সময়কার এক প্রভাবশালী নেতার কারণে তাকে জেলে যেতে হয়েছে।
মামলার নথি পরীক্ষায় দেখা যায়, হাজী নাছির উদ্দিন সরকার মোতাওয়াল্লি থাকাবস্থায় তারই চাচাতো ভাই এখলাছ উদ্দিন সরকার ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে উত্তরা পূর্ব থানায় ৩১৪/১৫ নং সাধারণ ডায়েরি রুজু করেন। বিগত ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট হাজী নাছির উদ্দিন সরকার জনৈক আদনান জোবায়ের এর কাছ থেকে স্কুলের জন্য মাদরাসা ভবনের তিনটি ফ্লোর ভাড়া দেয়ার নামে ২৪ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। পরে স্কুলের জন্য ফ্লোর ভাড়া না দেয়ায় এবং টাকাও ফেরত না দেয়ায় জোবায়ের সিএমএম কোর্টে হাজী নাছিরের বিরুদ্ধে ১০১৮/২০১৭ নং মামলা রুজু করেন, যা এখনো চলমান আছে।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা যায়, নাছির উদ্দিন সরকার বিগত ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর উচ্চ আদালতে ওয়াকফ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কমিটির বিরুদ্ধে ১৩৯১৪নং রিট মামলা রুজু করেন। ওই মামলায় ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই রায় হয়। এই রায়ে নাছিরের আবেদন খারিজ করা হয়। অতঃপর তিনি ১৩৯১৪/১৬নং মামলাটি পুনর্জীবিত/পুনঃবিচারের প্রার্থনা করলে উচ্চ আদালত মামলাটি ডিসমিস করে দেন। এতে ওয়াক্ফ এস্টেটের আদেশ বহাল থাকে।
হাজী নাছির হাইকোর্টে তার মামলা খারিজ হওয়ার পেছনে তদানীন্তন অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম আমিনুদ্দিন প্রভাব খাটিয়েছেন বলে দাবি করেন। তিনি আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থার ব্যাখ্যা করে বলেন, এর অর্থ হলো তার মোতাওয়াল্লি থাকার বিষয়টি ফিরিয়ে আনা। অন্যদিকে কমিটির সভাপতি মেজর আনিস বলেছেন, স্থিতাবস্থা মানে হলো যে অবস্থায় আছে সে অবস্থা বজায় রাখা। এ হিসাবে হাজী নাছিরের ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই।
পরিদর্শক আবুল কাশেম জানিয়েছেন, নাছির উদ্দিন সরকারকে মোতাওয়াল্লি পদে ফিরিয়ে আনার সুপারিশ তিনি করেছেন। নাছির উদ্দিন সরকার ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির প্রস্তাব করেছেন। এতে সভাপতি পদে তার ছেলে ফয়সাল সরকারের নাম দেয়া হয়েছে। আরেক ছেলে আরাফাত সরকারের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে কমিটির সদস্য হিসাবে। প্রস্তাবিত কমিটির আরেক সদস্য মাহতাব উদ্দিন তার আপন ভাই। ফয়সাল, আরাফাত ও মাহতাবের বিরুদ্ধেও অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা রয়েছে।
আবুল কাশেম সরকার ওয়াকফ দফতরের কাছে দেয়া চিঠিতে বলেছেন, নাছির উদ্দিন সরকার বিগত সরকারের আমলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং তার সহযোগিতায় এস্টেট কয়েকবার অবৈধভাবে দখল করার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়াও তিনি সাবেক সংসদ সদস্য (ঢাকা-১৮) হাবিব হাসান ও খসরু চৌধুরীর সাথেও যোগাযোগ করে কয়েক দফা অবৈধভাবে এস্টেট দখল করার চেষ্টা করেন। তিনি আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের পরামর্শক্রমে ঢাকা উত্তরের মেয়র ও সংসদ সদস্য পদেও প্রার্থী হয়েছিলেন।
নাছির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হলো, তিনি মোতাওয়াল্লির দায়িত্বে থাকাকালে যথারীতি হিসাব দাখিল করেননি এবং ধার্যকৃত ওয়াক্ফ চাঁদা পরিশোধ করেননি। তার সময় এই বাবদ ১২ লাখ ১৪ হাজার ৮৮৪ টাকা বকেয়া ছিল। বর্তমান কমিটি তার রেখে যাওয়া বকেয়া পরিশোধসহ ওয়াক্ফ চাঁদা নিয়মিত পরিশোধ করছেন এবং প্রত্যেক বছর হিসাব দাখিল করে আসছেন। ২০২১-২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত এস্টেটের আয় ব্যয়ের হিসাব অডিট সম্পন্ন করা হয়েছে।
এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এক আবেদনে বলা হয়েছে, নাছির উদ্দিন সরকার মোতাওয়াল্লি হিসেবে এস্টেট পরিচালনায় চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, দলিলের শর্ত ভঙ্গ, অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বিধায় তিনি মোতাওয়াল্লি নিয়োগ ও কমিটি অনুমোদনের যে আবেদন করেছেন তা বাতিলযোগ্য। অন্যদিকে এসব অভিযোগকে সত্য নয় বলে উল্লেখ করেন হাজী নাছির।
এই ওয়াকফ এস্টেটে মেজর (অব:) আনিসুর রহমান দুইবার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এস্টেটের উন্নয়ন ও তহবিল গঠনকল্পে সততার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন এলাকার অনেকে। তিনি উত্তরা কল্যাণ সমিতির তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি এবং বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজ সেবক। মেজর (অব:) আনিস নয়া দিগন্তকে বলেন, এই এলাকার মানুষ কোনোভাবেই মসজিদ ও মাদরাসার অর্থ আত্মসাতের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মোতাওয়াল্লি হিসেবে দেখতে চান না। নাছির এ ধরনের মামলা নেই বলে দাবি করলে সেটি হবে নির্জলা মিথ্যা।
এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালত থেকে তোলা নথিতে দেখা যায়, মামলাটি চলমান রয়েছে। গত ৬ নভেম্বর মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। এদিন মামলার আসামি হাজী নাছির উদ্দিন তার ছেলে আরাফাত ইবনে নাছির ও ফাহাদ ইবনে নাছির কোর্টে হাজির ছিলেন। পেনাল কোড ৪২০/৫০৬ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এ দিন ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য সময় ধার্য করা হয়।
ওয়াকফ পরিদর্শক আবুল কাশেম মনগড়া ও ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একতরফা তদন্ত প্রতিবেদন বাতিল করে মো: আবুল কাশেম সরকারের দাখিলকৃত কমিটি অনুমোদনের জন্য আহবান জানিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে ওয়াকফ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা