১১ বার অপারেশনের পরও নাড়াতে পারছেন না পা
- আমিনুল ইসলাম
- ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৩
পরিবারের বড় সন্তান সোহাগ (২৫)। ভ্যানে করে বাসাবাড়িতে খাবারপানি সরবরাহ করতেন। যা আয় হতো তাই দিয়ে চালাতেন বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পাঁচজনের সংসার। থাকতেন জুরাইনের ছোট্ট একটি বাসায়। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে সারা দিন কাজ শেষে রাতে ফিরতেন। অসুস্থ বাবা সপ্তাহে দু-এক দিন দিনমজুরি করলেও বাকি দিনগুলো কাজ করতে পারতেন না। ছোট ভাই ও বোন পড়ালেখা করত। এভাবেই চলছিল সোহাগের সংসার; কিন্তু গত প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে তার। অসুস্থ বাবা প্রতিদিন কাজে গিয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বন্ধ হতে বসেছে ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়া। মা অন্যের বাসায় কাজ নিয়েও হিমশিম খাচ্ছেন সংসার চালাতে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সোহাগ বলেন ‘আমি দিব্যি শুয়ে আছি হাসপাতালে। কোনো কাজ করা লাগছে না। হাসপাতাল থেকে তিনবেলা খাবার দিচ্ছে। গুলি খেয়ে উড়ে যাওয়া পায়ের যন্ত্রণার সাথে পরিবারের যন্ত্রণা আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না’।
বাবা-মা, ভাই-বোন কী করছে, কী খাচ্ছে সেসব ভেবে মাঝে মাধ্যে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কখনো কখনো ঘুমের ওষুধেরও প্রয়োজন হচ্ছে তার। সোহাগের প্রশ্নÑ আর কতদিন এভাবে হাসপাতালে থাকতে হবে তাকে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সোহাগ জানান, ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার সকাল থেকেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে চলছিল বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভ। কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার উপস্থিতির মধ্যে তিনিও ছিলেন। পানি বিক্রি বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের সাথে শামিল হন আন্দোলনে। সেদিন সকাল থেকে পুলিশ ছিল মারমুখো। থেকে থেকে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে থাকে। আবার বিক্ষোভকারীরাও একত্রিত হয়ে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। এভাবে চলে দুপুর পর্যন্ত। জুমার নামাজ রাস্তায় আদায় করেন বিক্ষোভকারীরা। তখন কেউ কিছুই করেনি। জুমার নামাজ শেষ হলে ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা শিফট চেঞ্জ করে। বাস ভরে আসে পুলিশের নতুন সদস্যরা। আর পুরনো ওই বাসেই চলে যায়। নতুন আসা পুলিশ সদস্যদের হাতে দেখা যায় ভারী মারণাস্ত্র। তাদের হাতে শর্টগান ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের গান ছিল কম। ছিল এলএমজি-রাইফেলসহ অন্যান্য অস্ত্র। আন্দোলন তখনো চলছে। বিকেল হতেই কোনো উসকানি ছাড়া বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়া শুরু করে পুলিশ। রাস্তায় অবস্থানরত অন্দোলনকারীরা এলোমেলো ছুটতে শুরু করেন। চোখের সামনে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। এমন সময় একটি গুলি এসে লাগে আমার বাম পায়ের হাঁটুর নিচে। দাঁড়িয়ে থাকা আমি ধপাস করে রাস্তায় পড়ে যাই। তাকিয়ে দেখি আমার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ নেই। হাড়-গোশত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে ছিল রাস্তায়। পায়ের পাতার অংশ ঝুলে ছিল রগের সাথে। রক্তক্ষরণে পুরো শরীর অবশ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর সবাই যখন ধরাধরি করে ভ্যানে তুলছিল তখন ব্যথা অনুভব করি, জ্ঞান ফেরে।
সোহাগ বলেন, গত সাড়ে পাঁচ মাসে ১১ বার অপারেশন করা হয়েছে। পায়ের উপর থেকে হাড়-গোশত কেটে জোড়া লাগানো হয়েছে। হাড়-গোশত হয়তো জোড়া লেগেছে; কিন্তু এখনো পায়ের পাতা নাড়াতে পারি না। কোনো অনুভূতিও আসেনি এখনো। আর অনুভূতি আসবে কি না সেটিও নিশ্চিত নয়। যার কারণে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হচ্ছে। সোহাগ বলেন, এতদিনে অনেকটা ঘরবাড়ির মতো হয়ে গেছে পঙ্গু হাসপাতাল; কিন্তু মন মানতে চায় না। তাই জোর করে চিকিৎসকদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম মায়ের কাছে। কয়েকদিন থাকার পর ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। যার কারণে এক সপ্তাহ থেকে আবার ফিরে এসেছি হাসপাতালে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা