হাসপাতাল ছাড়পত্র না দেয়ায় আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন না রুমেল
- আমিনুল ইসলাম
- ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭
রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে পুলিশ গুলি করে রুমেল মিয়ার পায়ে। একটি নয়, একাধিক গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় কোমর থেকে ডান পায়ের পাতা পর্যন্ত। মুহূর্তেই জ্ঞান হারান রুমেল। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে দেখেন একটি হাসপাতালে। লোকমুখে জানতে পারেন ওই হাসপাতালের নাম কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগ। তখন ডান পায়ের কোমর থেকে পাতা পর্যন্ত ফেড়ে আবার সেলাই করা দেখতে পান। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই রুমেলের পাশে। শুধু কয়েকজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল। পাশের বেডে কয়েকজন রোগী থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলছিল না।
এই অবস্থা দেখে পায়ের যন্ত্রণার সাথে ভয় পেয়ে বসে রুমেলকে। ডাক্তার নার্সের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে পুলিশ সদস্যরা এসে বলে ‘আমরা যেভাবে বলব, সেভাবে চলবি, না হলে বাঁচতে পারবি না’। ভয়ে শুধু হাঁ সুচক জবাব দিয়ে গেছেন তিনি। ৪/৫ দিন পর কোনো কাগজ (ছাড়পত্র) ছাড়াই একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয় তাকে। সেখানে বিনা চিকিৎসায় পায়ে পচন ধরায় এলাকার লোকজন রুমেলকে ভর্তি করে ঢাকা মেডিক্যালে। তারপর নেয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা পেলেও কাগজপত্র না থাকায় আর্থিক অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রুমেল। কাগজের জন্য একাধিকবার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে গেলেও তারা কোনো সহযোগিতাই করছে না। যার কারণে চরম অর্থিক কষ্টে থাকতে হচ্ছে রুমেলকে। হোটেল কর্মচারীর সামান্য বেতনে যে মায়ের খরচ মেটাতেন, সেই মা এখন ছেলের চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পাতছেন। ঋণ করছেন।
সরেজমিনে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডান পায়ের হাঁটুতে বড় ধরনের ব্যান্ডেজ করা। পুরো পা ফাঁড়া তবে সেগুলো অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। শুধু সেলাইয়ের দাগগুলো যেন তাকিয়ে আছে। কিন্তু হাঁটুর অংশে পচন ধরায় সেই ঘা শুকাতে চাইছে না। ডাক্তারা জানিয়েছেন তার পায়ের মধ্যে অসংখ্য গুলি রয়ে গেছে। যা এখনই বের করা সম্ভব নয়।
সিলেটের হবিগঞ্জের ছেলে রুমেল মিয়া (২৭) রায়েরবাগের একটি খাবারের দোকানের সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। দনিয়া কলেজের একজন ছাত্রের সাথে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই যুক্ত হন। আন্দোলন যখন বাড়তে থাকে পুলিশও কঠোর অবস্থানে যেতে থাকে। শনিরআখড়া ব্রিজের নিচে তৈরি করা হয় একটি চেকপোষ্ট। যেখান দিয়ে যাওয়ার সময় সবাইকে দুই হাত উঁচু করে যেতে হতো। হাত উঁচু না করলেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করত। গত ১৮ জুলাই রাত ৯টার আন্দোলনের স্পট থেকে দুই সহযোদ্ধার সাথে বাসায় ফিরছিলেন রুমেল। শনিরআখড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় দুই হাত উঁচু করে যাচ্ছিলেন। তারপরও পুলিশ তাকে ধরে গাড়িতে তোলে। এরপর পেছন দিক দিয়ে হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। রুমেল বাঁচার জন্য চিৎকার দিলেই শুরু হয় মারধর। এরপর গাড়ি চালিয়ে কোনো একটি ঘরে নেয়া হয় তাকে। সেখানে কয়েকজনকে বলতে শোনা যায় ‘এ দেরি করার দরকার নেই। কাজ শেষ করো, আবার বের হতে হবে। এরপর হাঁটুর উপরে প্রথম গুলিটা করা হয়। প্রথম গুলিতেই জ্ঞান হারান রুমেল। এরপর যখন জ্ঞান ফেরে তখন হাসপাতালের বেডে শোয়াছিলেন তিনি।
রুমেল বলেন, তিনি পড়ালেখা জানেন না। যার কারণে কোনো কিছু পড়তে পারেননি। তবে তার বেডের পাশে সবসময় পুলিশ পাহারায় থাকত। এক ফাঁকে পাশের একজনের কাছে জানতে চান এটা কোথায়। তিনি বলেন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল।
এভাবে ৩/৪ দিন চিকিৎসা চলার পর কয়েকজন পুলিশ রুমেলকে বলে, তোমাকে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। সোজা গ্রামের বাড়ি চলে যাবা। ফোনটাও রেখে দেয় পুলিশ। চিকিৎসার কোনো প্রকার কাগজ না দিয়েই তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়। এরপর সেটি চলে রায়েরবাগ মুসলিমনগর তার কর্মস্থলে। সেখানে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় অ্যাম্বুলেন্স। তারপর রুমেলের বাড়িতে ফোন করা হলে তার পরিবারের লোকজন এসে নিয়ে যান।
রুমেল বলেন, বাড়ি গিয়ে ঘরের মধ্যেই থাকতেন। কিন্তু কিছু দিন পর বিনা চিকিৎসায় ইনফেকশন হতে থাকে তার ক্ষতস্থানে। যার কারণে প্রতিবেশীরা টাকা দিয়ে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে পাঠানো হয় পঙ্গু হাসপাতালে। বর্তমানে এখানে চিকিৎসা পেলেও পূর্বের কাগজ না থাকায় কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। চিকিৎসার কাগজের জন্য একাধিকবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে গেলেও তারা সহযোগিতা করছে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা