সময়ের স্বল্পতা থাকলেও পাঠ্যবইয়ের কাগজ ও ছাপার মানে ছাড় দেইনি
একান্ত সাক্ষাৎকারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান- শাহেদ মতিউর রহমান
- ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪০
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান মনে করেন, পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটালে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। তাই যে বা যার অবদান যতটুকু পাঠ্যবইয়ে তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতে হয়। যদিও চলতি বছরের পাঠ্যবই মুদ্রণে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল না, কিন্তু তারপরেও বইয়ের কাগজ ও ছাপার মানে এনসিটিবি কোনো ছাড় দেয়নি।
ইতিহাসের বিকৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অতীতে এ বিষয়টিকে একেবারেই মানা হয়নি। পাঠ্যবইয়ের বর্ণনায় কাউকে কাউকে সম্মানের এমন উচ্চতায় বসানো হয়েছে যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা নিজেদের উপলব্ধি থেকেই প্রতিবাদ করেছে। যার প্রতিধ্বনি আমরা চব্বিশের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের বিভিন্ন স্লোগানে শুনতে পেয়েছি।
দৈনিক নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহেদ মতিউর রহমান।
নয়া দিগন্ত: এখনোতো সবাই বই পায়নি, শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই কবে নাগাদ পৌঁছাবে?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: এককথায় এর উত্তর দেয়া কঠিন। তবে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়ার জন্য পাঠ্যবই মুদ্রণ থেকে শুরু করে স্কুলে পাঠানো পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এর বাইরেও অনেকগুলো বিষয় থাকে। বিশেষ করে কাগজ, ছাপা ও বাইন্ডিংয়ের মান- এসব বিষয় নিশ্চিত করতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ করতে হয় এনসিটিবিকে। চলতি বছরে আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি বইয়ের মান যেন খারাপ না হয়। যদিও আমাদের হাতে সময়ের স্বল্পতা ছিল, কিন্তু এরপরও কাগজের ও ছাপার মানের বিষয়ে আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেইনি। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে কথা বলে দেখবেন তারাই স্বীকার করবে এ বছরের বইয়ের মান অতীতের যেকোনো বছরের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। আমরা সর্বোপরি যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে তাতে চলতি মাসের (৩১ জানুয়ারি) মধ্যেই দশম শ্রেণীর সব বই এবং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দিতে সক্ষম হবো।
নয়া দিগন্ত: অনেকে অভিযোগ করছেন এবার বছরের প্রথম দিনে আপনারা বই দিতে পারেননি। এটা কি আপনাদের ব্যর্থতা নয়?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: অবশ্যই না। কেননা আমাদের হাতে এবার পর্যাপ্ত সময় ছিল না। আগের বছরগুলোতে যখন বই ছাপা শুরু হতো, এ বছর তখন আমাদের টেন্ডার প্রক্রিয়াই শেষ করতে পারিনি। এ ছাড়া অতীতে কোনো বছরই কিন্তু জানুয়ারির প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পায়নি। এটা ছিল আওয়ামী লীগের একটি প্রতারণা মাত্র। এনসিটিবি এবং প্রেসগুলো থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড বলছে বিগত বছরগুলোতে মার্চ, এপ্রিল; এমনকি জুলাই মাস পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বই হাতে পাওয়ার জন্য। তবে আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দেয়ার জন্য। অবশ্য আমরা জানুয়ারির প্রথম দিনেই প্রাথমিকের নিচের দিকের তিনটি ক্লাসের (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণী) অধিকাংশ স্কুলে বই পৌঁছে দিতে পেরেছি। এ ছাড়া মাধ্যমিকের কয়েকটি শ্রেণীর বই আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। তবে এ বছর যেহেতু দশম শ্রেণীর জন্য নতুন করে অতিরিক্ত সাড়ে ৬ কোটি বই ছাপতে হচ্ছে, তাই সময়ও একটু বেশি লাগছে।
নয়া দিগন্ত: পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের সর্বশেষ অবস্থা জানাবেন কি?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: দেখুন, বর্তমানে বই ছাপার গতি যেভাবে বেড়েছে তাতে আমরা আশা করছি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই সব শিক্ষার্থীর হাতে বাকি বই পৌঁছে দিতে পারব ইনশাআল্লাহ। তবে একটি কথা এখানে পরিষ্কার করা দরকার, সেটি হলো আমরা কিন্তু এখন অগ্রাধিকার দিচ্ছি দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের। কেননা তারা ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। কিন্তু পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে মাত্র এক বছর। আগের কারিকুলাম বাতিল এবং নতুন করে পাঠ্যবই মুদ্রণের কারণে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও নতুন বই পাচ্ছে। যদিও আগে নবম শ্রেণীতে পাওয়া বই দিয়েই দুই বছর পড়াশোনা করে এসএসসি পরীক্ষা দিতো। এ বছরই ব্যতিক্রম যে, দশম শ্রেণীতে নতুন বই এবং গ্রুপ বিভাজন করে (মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান) তারা এক বছর পড়েই ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
নয়া দিগন্ত: তাহলে দশম শ্রেণীর পাঠ্যবই ছাপা কতদূর?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: বলতে পারেন প্রায় শেষ। আজ (২৩ জানুয়ারি) অথবা আগামীকালের মধ্যেই সব বই ছাপা শেষ হবে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রেসগুলো থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, সেখানে দশম শ্রেণীর মোট ৬ কোটি ৪৯ লাখ বইয়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ইতোমধ্যে ছাপা হয়ে গেছে। বাকি বই ছাপতে হয়তো এক বা দু’দিন সময় লাগবে। দশম শ্রেণীর বইগুলো বেশি মোটা, অর্থাৎ ফর্মা বেশি। কোনো বই ৪০ বা ৪২ ফর্মা পর্যন্ত। এগুলো ছাপা ও বাইন্ডিংয়েও সময় বেশি লাগে। তবে তারপরও আমাদের যে প্রস্তুতি রয়েছে, তাতে চলতি মাসের মধ্যেই দশম শ্রেণীর সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে।
নয়া দিগন্ত: এবারতো বছরের প্রথম দিনে বই উৎসব হলো না। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: হ্যাঁ, এটা ঠিক। তবে উৎসব না হলেও শিক্ষার্থীদের কিন্তু আনন্দের কোনো কমতি ছিল না। আমরা বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিকের তিনটি ক্লাসের বই বিতরণ করেছি। মাধ্যমিকেরও বিভিন্ন ক্লাসের বই দিয়েছি। এ ছাড়া বইয়ের প্রিন্ট ভার্সনের সব বই ছাপা শেষ না হওয়ায় আমরা কিন্তু পিডিএফ ভার্সন বছরের প্রথম দিনেই ওপেন করে দিয়েছি। অনেক শিক্ষার্থী পিডিএফ থেকেই ডাউনলোড করে প্রথম দিনই পড়াশোনা শুরু করতে পেরেছেন। যেহেতু আপনি প্রসঙ্গটি এখানে এনেছেন তাই একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়; বিগত বছরগুলোতে বই উৎসবের আড়ালে অর্থ লুটপাটের আয়োজন হয়েছে। সব রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে। বেশ কয়েকটি বিল-ভাউচারের কপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বই উৎসবের নামে ২০২১ সালের পর ২০২২ সালেই মাত্র এক বছরের ব্যবধানে হল ভাড়া বাবদ ব্যয় ১০ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। ২০২১ সালের বই উৎসবের ঢাকার একটি হল ভাড়া বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৩ শ’ টাকা। কিন্তু এক বছর পরেই ২০২২ সালে একই হলের ভাড়া অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য হলেও দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬২ টাকা। বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ চার বছরে শুধুমাত্র এনসিটিবি থেকেই ১৫টি বিলের মাধ্যমে ৭৩ লাখ ২১ হাজার তিন টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে বই উৎসবের আড়ালে প্রকৃত অর্থে টাকা ভাগবাঁটোয়ারাই হয়েছে বেশি।
নয়া দিগন্ত: মাধ্যমিকের বিভিন্ন ক্লাসের বাকি বই ছাপার অগ্রগতি কতদূর?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: মাধ্যমিকের মোট বই সংখ্যা ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি। ইতোমধ্যে প্রায় ১২ কোটি ছাপা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৮ কোটি বইয়ের পিডিআই (প্রি ডেলিভারি ইনস্পেকশন) সম্পন্ন হয়েছে। অধিকাংশ বই জেলা-উপজেলায় পৌঁছেও দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও পর্যায়ক্রয়ে তাদের বই হাতে পাচ্ছে। আশা করছি ফেব্রুয়ারির দি¦তীয় সপ্তাহের মধ্যেই সব বই পেয়ে যাবে শিক্ষার্থীরা।
নয়া দিগন্ত: প্রাথমিকের বাকি বই মুদ্রণের সর্বশেষ আপডেট জানাবেন কি?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: প্রাথমিকের সব বই ছাপা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণির কিছু বই ছাপার বাকি রয়েছে। এগুলোও ছাপা শুরু হচ্ছে।
নয়া দিগন্ত: পাঠ্যবইয়ে এবার অনেক কিছুই নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। এর কারণ কী?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: শিক্ষার্থীদের পাঠ্যইয়ের রচনায় কারো প্রতি বিদ্বেষ কিংবা কারো প্রতি অতি তোষণ শোভনীয় বা উচিতও নয়। আমরা চেষ্টা করেছি ২০২৫ সালের পাঠ্যবইয়ে আমাদের প্রয়াত রাজনীতিবিদদের সবার প্রতি ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্মান দেখাতে। এখানে কাউকে ঘৃণার সাগরে ভাসিয়ে যেমন দেয়া হয়নি, তেমনি কাউকেই আবার অতি মহান হিসেবেও উপস্থাপন করা করা হয়নি। ইতিহাসে যার যে ভূমিকা এবং যে যতটুকু সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে তাকে সেভাবেই সম্মান দেখানো হয়েছে।
নয়া দিগন্ত: পাঠ্যবইয়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের অনেক স্মৃৃতি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বিষয়গুলোকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: আপনি জানেন, ২০২২ সালের বিতর্কিত কারিকুলাম এদেশের অভিভাবক সমাজ এমনকি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও অংশ নেয়নি। তারা শুরু থেকেই এ বিতর্কিত কারিকুলামের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিবাদী এবং সোচ্চার। তাই অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই সেই বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিল ঘোষণা করেন এবং নতুন করে ২০১২ সালের কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে নতুন করে পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজও শুরু করতে হয়েছে। সেজন্য পাঠ্যবই ছাপার কাজের আগের টেন্ডার বাতিল করে নতুন করে আহ্বান করতে হয়েছে। শিক্ষার্থী ও দেশবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের কারিকুলামও পরিমার্জন করে সেখানে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের অনেক স্মৃতি সংযুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে পাঠ্যবইয়ে চব্বিশের শহীদের ইতিহাস, বিভিন্ন গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে। নতুন পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় দেশ এবং দেশের মানুষের আশাআকাক্সক্ষার প্রতিফলনও ঘটেছে।
নয়া দিগন্ত: আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান: আপনাকে এবং নয়া দিগন্তকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা