হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মনিরের দুই পা
- আমিনুল ইসলাম
- ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৯
২০২৪ সালের ২০ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টা। গাজীপুর চৌরাস্তায় চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার উত্তাল বিক্ষোভ। মূল রাস্তা অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষ স্লোগানে প্রকম্পিত করছিল চারদিক। এরকম মুহূর্তেও গুলি-টিয়ার শেল সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে প্রায় ক্লান্ত ছিল পুলিশ। তবুও পিছপা হয়নি একজন আন্দোলনকারীও। বরং সেখানে নামতে থাকে জনতার ঢল। ঠিক তখনই বিকট শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে বিক্ষোভ স্থানের দিকে আসতে থাকে বিজিবির একটি হেলিকপ্টার। সেখান থেকে ভারী অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ছোড়া হয় এলোপাতাড়ি গুলি। যার একটি গুলি বিদ্ধ হয় মনির হোসেনের (৩০) ডান পায়ের হাঁটুর নিচে। ডান পায়ে লাগলেও এক গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মনিরের দু’টি পাই। দুই পায়েরই হাড় ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গোশতসহ বেরিয়ে যায়। শুধু মাত্র রগের সাথে দুই পায়ের পাতা ঝুলতে থাকে।
গত প্রায় ছয় মাসে ১২ বার অপারেশন করা হয়েছে মনিরের দুই পায়ে। কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো হাসপাতালের বিছানায় সুস্থতার প্রহর গুনছেন তিনি।
রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পা দুটো বালিশে রেখে তুলা দিয়ে কিছু একটা মোছার চেষ্টা করছেন মনির। তার দুই পায়ে ৮ থেকে ১০ করে রড ঢুকিয়ে এলিজা করে রাখা হয়েছে। বেডের নিচে ছোট মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন তার স্ত্রী। কেমন আছেন জানতে চাইলে মনির বলেন, মৃত্যু কেমন জানি না। তবে জীবিত অবস্থায় এত কষ্ট আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ছয় মাস পা দুটো বালিশের ওপর তুলে রেখেছি। অন্যের সাহায্য ছাড়া কোনো কাজ করতে পারছি না।
মনির হোসেন বলেন, গাজীপুরের লেভেনডার ফ্যাশন লিমিটেড নামক গার্মেন্টসের লাইন চিফ হিসাবে কাজ করতেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালি। স্ত্রী, দুই সন্তান ও পরিবারে আরো তিন সদস্যকে নিয়ে চৌরাস্তা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় ছিল তার সংসার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সাথে সমন্বয় রেখে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। ২০ জুলাই সকাল থেকেই গাজীপুর চৌরাস্তা অবরোধ করেন তারা। সেখানে চলতে থাকে ব্যাপক বিক্ষোভ। পুলিশের সাথে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। একের পর এক গুলি চালাতে থাকে পুলিশ। সেই সাথে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। পুলিশ যখন গুলি চালাতে থাকে তখন একটু ছত্রভঙ্গ হলেও কেউ রাস্তা ছাড়ছিল না। এতে করে অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল পুলিশ।
কিন্তু ঠিক ওই সময় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আকাশ কাঁপিয়ে আসতে থাকে বিজিবির হেলিকপ্টার। দুই পাশের দরজা খোলা রেখে ভারী অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে তারা। তাদের ছোড়া গুলি যখন রাস্তায় বিদ্ধ হচ্ছিল তখন রাস্তার পিচ গ্রেনেড বিস্ফোরণের মতো উড়ে যাচ্ছিল। এই পরিস্থিতি দেখে অনেকেই মাথায় হাত দিয়ে রাস্তা থেকে সরে পাশের ভবনের দিকে ছুটতে থাকে। ওই সময় একটি গুলি এসে লাগে আমার ডান পায়ে। কাকতালীয় ভাবে পা দুটো পাশাপাশি থাকায় ডান পায়ে লাগা গুলি বিদ্ধ হয়ে বাম পা ভেদ করে হাড়-গোশত চামড়া ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। পায়ের পাতার ওপরের হাড় না থাকায় মুুহূর্তের মধ্যে আমি ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।
জ্ঞান থাকা অবস্থায় তাকিয়ে দেখি আমার দুটো পা নেই। এরপর তেমন কিছু মনে নেই। শুধু অনুভব করছিলাম সঙ্গীরা আমাকে ধরাধরি করে কোনো একটি অটোরিকশায় তোলার চেষ্টা করছে। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করি টাঙ্গাইল সিটি হাসপাতালে। তবে তারা আমাকে রাখে নাই। পরে নেয়া হয় গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠানো হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে।
এখানে গত ছয় মাসে ১২ বার অপারেশন করা হয় তার দুই পায়ে। গুলিতে টুকরো টুকরো হওয়ায় হাড় কেটে সমান করে শরীরের অন্য জায়গা থেকে হাড় গোশত কেটে এনে পায়ে জোড়া লাগানো হয়েছে। এতে তার স্বাভাবিক উচ্চতার চাইতে তিন ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছেন তিনি। তিনি বলেন, তাতেও কষ্ট নেই। কিন্তু একটু দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলে মনে হয় জীবন ফিরে পেতাম। ছয় মাস ধরে হাসপাতালের বিছানায় কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া হাসপাতাল ছাড়তে আরো কত মাস লাগবে তারও নির্দিষ্ট কোনো সময় কারো জানা নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা