বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পোশাক খাত
প্রতিযোগিতায় টিকতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি- শাহ আলম নূর
- ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৪
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি ও দেশের অর্থনীতির বাস্তব চিত্র আড়াল করে ফুলিয়ে ফাপিয়ে অর্থনীতির অনেক সূচক স্ফীত করে দেখিয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত করার নানা ফন্দিফিকির চালিয়েছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপী দেশগুলোতে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের অনেক সুযোগ সুবিধা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। এমতাবস্থায় ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার জন্য বাংলাদেশ কতটুকু যোগ্যা তা পর্যালোচনার সময় এসেছে। পাশাপাশি দেশী এবং বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে অস্থিরতা লেগেই থাকছে। সাথে ঝুলছে গ্যাসের দাম বাড়ানোর খড়গ। এমনি পরিস্থিতিতে দেশের রফতানি বাণিজ্যে শীর্ষে অবস্থান করা পোশাক শিল্প নানমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে পোশাক শিল্পকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি আদেশ কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে। একই সাথে ব্যাংকের সুদ বৃদ্ধি পাওয়াতে উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ আরো বেড়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়তি ব্যয়ের সংস্থান করতে না পেরে লোকসানে থাকা অনেক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, রফতানি বাণিজ্যে দেশের গার্মেন্ট খাতে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। এ দিকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর তৈরী পোশাক শিল্পের বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে রফতানি বাড়াতে পদক্ষেপ জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ইতোমধ্যে বস্ত্র খাতের শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) নেতারা বলছেন দীর্ঘ সময় জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বস্ত্র খাত স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। কয়েক মাস যাবৎ গ্যাস সঙ্কট এমন আকার ধারণ করেছে যে মিলগুলো উৎপাদনক্ষমতার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। এ দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে কমেছে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার জন্য বাংলাদেশ কতটুকু যোগ্যা তা পর্যালোচনার সময় এসেছে। পাশাপাশি নানা কারণে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। এ দিকে দেশী এবং বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে অস্থিরতা লেগেই থাকছে। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি খুবই জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
(এফবিসিসিআই)-এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে গার্মেন্ট খাতের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অনেক কষ্টে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আঘাত আসছে। এ জন্য গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। দেশের গার্মেন্ট খাতে অস্থিরতার কারণে ৫ আগস্টের পর রফতানি আদেশের ২০ শতাংশ অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ করা হয়েছে এটি গার্মেন্ট খাতে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। দাম বেশি দিয়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। বরং সারা দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সম্মুখিন হচ্ছে কারখানগুলো।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমিত মূলধনের ছোট পোশাক কারখানাগুলো বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্স পাচ্ছে না। এতে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র (এলসি) করতে সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে এ সব কারখানা। এমন পরিস্থিতিতে কাঁচামাল, অ্যাক্সেসরিজ আমদানিতে বেশ জটিলতার সম্মুখিন হচ্ছে ছোট কারখানগুলো। এলসি জটিলতায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ হ্রাস পাওয়ায় বন্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে এক হাজারেরও বেশি নন-বন্ডেড পোশাক কারখানা। কারণ বন্ড লাইসেন্স পেতে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এসব শর্ত পূরণ ছোট মূলধনের প্রতিষ্ঠানের জন্য জন্য প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) তথ্যে দেখা যায় দেশের রফতানি বাণিজ্যে নন-বন্ডেড পোশাক কারখানাগুলোর অবদান মূল্য প্রায় ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছে প্রায় সাত লাখ শ্রমিক। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাঠানো এক চিঠিতে বিজিএমইএ বলছে, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি জোগাড় করতে না পারার কারণে নন-বন্ডেড শতাধিক পোশাক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়েছে। বাকি কারখানাগুলোও বন্ধ হওয়ার একই ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এ দিকে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম। দেশটির ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এমন উদ্যোগের কারণে ইউরোপের বাজারে পোশাক রফতানিতে বিশেষ সুবিধা পাবে ভিয়েতনাম। যেটি বাংলাদেশ পাবে না। এতে ইউরোপের বাজারে ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি বাড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের রফতানি বাণিজ্যে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় দেশের মোট পোশাক রফতানির ৮২ শতাংশ হয় ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে। এসব বাজারের মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। অর্থাৎ দেশটিতে মোট রফতানির ২২ শতাংশ হয়ে থাকে। জার্মানিতে ১৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ তৈরী পোশাক রফতানি হয়ে থাকে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায় বাংলাদেশের পোশাক রফতানির বড় বাজার আমেরিকা ও ইউরোপ। এসব দেশে রফতানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব বেশ ভালোভাবে পড়বে পোশাক শিল্পে।
স্পারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশের পোশাক শিল্প বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে পোশাক তৈরিতে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। একই সাথে রফতানি আদেশ দেয়ার পর তা দ্রুত সময়ে জাহাজীকরণ আবশ্যক। একই সাথে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত উৎপাদন ও খরচ জরুরি বলে তিনি মনে করেন। এ দিকে রফতানি বাণিজ্য বাড়াতে নতুন বিশ্ববাজার খুঁজে বের করতে হবে। কারণ দেশের পোশাক খাত নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এজন্য নতুন বাজার সন্ধানে সরকারের সরাসরি সহযোগিতা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, জুলাই বিপ্লব দেশের পোশাক শিল্পের জন্য বিশেষভাবে আশাজাগানিয়া ছিল। যদিও এ জন্য দেশের পোশাক শিল্পকে বড় মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া অস্থিরতা, তার সাথে দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঘটনা যুক্ত হয়ে শীত ও ক্রিসমাসকে সামনে ক্রয়াদেশ কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি করেছে। এসবের প্রভাবে সাপ্লাই চেইন ও উৎপাদন সময়সূচি ব্যাপকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেক কনফার্মড অর্ডারও আমাদের পাশের দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০২৩ সালের জুলাই মাসের তুলনায় ২০২৪ সালের জুলাই সময়ে রফতানি বাণিজ্য মাত্র ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। এ দিকে ২০২২ সালের জুলাইয়ের তুলনায় ২০২৩ সালের জুলাই সময়ে রফতানি ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের আগস্টে রফতানি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।